Radical feminism

চরমপন্থী নারীবাদ কি? উদ্দেশ্য, বৈশিষ্ট্য এবং সমালোচনা

চরমপন্থী নারীবাদ হলো এমন একটি নারীবাদী মতবাদ, যেখানে সমাজে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকে নারীর শোষণ ও বঞ্চনার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ মতবাদ বিশ্বাস করে যে নারীর প্রকৃত স্বাধীনতা ও সমতা অর্জনের জন্য সমাজের প্রচলিত কাঠামো, বিশেষ করে পুরুষশাসিত মানসিকতা ও প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে নতুনভাবে গড়ে তোলা প্রয়োজন। আমরা খুব সংক্ষেপে জানলাম যে চরমপন্থী নারীবাদ কি। তবে এই ধারনাটি পরিষ্কার করার জন্য আরও একটু বিশদ আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। চলুন চরমপন্থী নারীবাদ সম্পর্কে আরও একটু গভীরে যাওয়া যাক। 

আরও পড়ুনঃ উদারপন্থী নারীবাদ কি?

চরমপন্থী নারীবাদ কি? 

চরমপন্থী নারীবাদ (Radical Feminism) হলো এমন এক নারীবাদী মতবাদ, যেখানে নারীর উপর শোষণ ও বৈষম্যের মূল উৎস হিসেবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে চিহ্নিত করা হয়। এ মতবাদ মনে করে, নারীকে প্রকৃত অর্থে মুক্ত করতে হলে কেবল কিছু অধিকার দেওয়াই যথেষ্ট নয়; বরং পুরুষশাসিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোকে ভেঙে নতুনভাবে সাজানো প্রয়োজন।

চরমপন্থী নারীবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। অনেকেই “চরমপন্থী” শব্দটি শুনে একে উগ্র বা হিংসাত্মক মতবাদ বলে মনে করেন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এর উদ্দেশ্য ভিন্ন। এখানে “চরমপন্থী” বলতে বোঝানো হয়েছে গোড়ায় ফেরা। “Radical” শব্দটি লাতিন শব্দ radix থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো মূল বা শিকড়।

চরমপন্থী নারীবাদের উত্থান ঘটে মূলত ষাটের দশকের শেষ ভাগে এবং সত্তরের দশকের শুরুতে। তখনকার উদারপন্থী নারীবাদীরা বিশ্বাস করতেন, বিদ্যমান সামাজিক ব্যবস্থার ভেতরেই কিছু সংস্কারের মাধ্যমে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে কিছু নারী আন্দোলনকারী লক্ষ্য করলেন, কেবল আইন পরিবর্তন বা সমানাধিকারের দাবি নারীর প্রকৃত সমস্যার সমাধান দিচ্ছে না।

পরিবারের ভেতরে, ব্যক্তিগত জীবনে নারীরা যে নির্যাতন, যৌন হয়রানি ও শোষণের শিকার হচ্ছেন, সে প্রসঙ্গে উদারপন্থী নারীবাদ যথেষ্ট জোর দিচ্ছিল না। এই অভিজ্ঞতা থেকে নারীদের একাংশ উপলব্ধি করলেন যে, শুধু বাহ্যিক কাঠামো নয়, বরং সমাজের গভীরে প্রোথিত মূল কাঠামোকেই আমূল পরিবর্তন করা জরুরি। এই চিন্তাধারার ফলেই চরমপন্থী নারীবাদের জন্ম হয়।

চরমপন্থী নারীবাদের উদ্দেশ্যঃ  

চরমপন্থী নারীবাদের বেশ কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে যা একে অন্য নারীবাদের ধারণা থেকে আলাদা করে। দেখে নেয়া যাক চরমপন্থী নারীবাদের উদ্দেশ্য গুলো কী কীঃ

  • পুরুষতন্ত্রকে মূল সমস্যা হিসেবে দেখা

চরমপন্থী নারীবাদের মূল বক্তব্য হলো নারীর উপর শোষণ ও বৈষম্যের আসল উৎস হলো পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। পরিবার, শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, এমনকি রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রতিটি স্তরেই পুরুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা নারীর স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই এই কাঠামো পরিবর্তন ছাড়া নারীর প্রকৃত মুক্তি সম্ভব নয়।

  • সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তনের দাবি

শুধু কিছু আইন পরিবর্তন বা সংস্কার নারীর সমস্যার সমাধান করতে পারে না। চরমপন্থী নারীবাদীরা মনে করেন, নারী-পুরুষের সমতা আনতে হলে পুরো সামাজিক ব্যবস্থা, মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে হবে। 

  • শারীরিক ও যৌন শোষণের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান

এই মতবাদ বিশেষভাবে নারীর দেহ ও যৌনতার উপর পুরুষতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করে। তারা যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, যৌনবাণিজ্য এবং পর্নোগ্রাফিকে নারীর শোষণের প্রধান মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাঁরা মনে করেন, নারীর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হলে এসব শোষণমূলক কর্মকাণ্ড দূর করা অপরিহার্য।

  • নারীর স্বকীয় সত্তার ওপর জোর

চরমপন্থী নারীবাদ নারীর ব্যক্তিস্বাধীনতা ও আত্মপরিচয়ের গুরুত্ব দেয়। এর উদ্দেশ্য হলো নারীদের পুরুষনির্ভর জীবন থেকে বের করে এনে তাদের নিজস্ব সত্তা ও স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করা। 

  • রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের দাবি

চরমপন্থী নারীবাদ কেবল ব্যক্তিগত জীবনের সীমাবদ্ধতাগুলো ভাঙতে চায় না, বরং বৃহত্তর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও নারীর সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে চায়। এভাবে সমাজে সত্যিকারের সমতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।

চরমপন্থী নারীবাদীরা কোন কোন বিষয়ে তীব্রভাবে প্রতিবাদ ও বিশ্লেষণ করেছেন?

Radical feminism theory

চরমপন্থী নারীবাদীরা সমাজে নারীর শোষণের মূল ভিত্তি খুঁজে বের করতে গিয়ে কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ ও বিশ্লেষণ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ 

লেসবিয়ান নারীবাদ

চরমপন্থী নারীবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা হলো লেসবিয়ান নারীবাদ। এ ধারার চিন্তাবিদরা মনে করেন, নারী যখন অন্য নারীকে ভালোবাসেন, তখন তা শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, বরং পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক প্রতিবাদ।

পর্নোগ্রাফি

তাদের মতে পর্নোগ্রাফি কোনো শিল্প বা যৌন স্বাধীনতার প্রতিফলন নয়। বরং এটি নারীর প্রতি সহিংসতা ও শোষণের একটি হাতিয়ার। পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে নারীকে কেবল যৌন ভোগের পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয় এবং পুরুষের আধিপত্যকে বৈধতা দেওয়া হয়।

শারীরিক ও যৌন সহিংসতা

তাদের মতে নারীর বিরুদ্ধে শারীরিক ও যৌন সহিংসতা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। এই সহিংসতার মাধ্যমে পুরুষরা তাদের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে।

পতিতাবৃত্তি

চরমপন্থী নারীবাদীরা পতিতাবৃত্তিকে স্বাধীন পেশা হিসেবে মানতে অস্বীকার করেন। তাদের দৃষ্টিতে এটি নারীর উপর পুরুষের যৌন শোষণ ছাড়া আর কিছু নয়। তারা মনে করেন, প্রকৃত অর্থে এটি কখনো স্বেচ্ছায় হতে পারে না; বরং পুরুষশাসিত ক্ষমতাই একে টিকিয়ে রাখে।

চরমপন্থী নারীবাদের বৈশিষ্ট্যঃ 

চরমপন্থী নারীবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো বোঝা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলোই দেখায় কিভাবে নারীর স্বকীয়তা, স্বাধীনতা এবং সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপঃ 

  • পুরুষতন্ত্রকে নারীর শোষণ ও বৈষম্যের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা।
  • নারীর মুক্তির জন্য সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তনের দাবি করা।
  • যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, ও নারীর দেহকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে ব্যবহারের বিরোধিতা করা।
  • নারীর স্বকীয় সত্তা ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেওয়া।
  • রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নারীর সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করা।

চরমপন্থী নারীবাদের সমালোচনাঃ 

চরমপন্থী নারীবাদ নারীর শোষণ ও বৈষম্যের মূল শিকড় উন্মোচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও, এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এটি প্রায়শই সব নারীর অভিজ্ঞতাকে একইভাবে দেখার চেষ্টা করে। বাস্তবে নারীদের জীবন সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও জাতিগত ভিন্নতার কারণে ভিন্ন। চরমপন্থী নারীবাদ ব্যক্তি এবং পরিবারের ক্ষেত্রে পিতৃতন্ত্রের বিশ্লেষণে অতিরিক্ত মনোযোগ দেয়, যা কখনও বাস্তবসম্মত সমাধান থেকে দূরে চলে যেতে পারে। 

এছাড়া, এই ধারা প্রায়শই মধ্যবিত্ত বা উচ্চশ্রেণীর নারীর অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে, ফলে নিম্নবিত্ত, শ্রমজীবী বা গ্রামীণ নারীদের সমস্যা পর্যাপ্তভাবে বিশ্লেষিত হয় না। অনেক সময় মূল কাঠামো পরিবর্তনের ওপর জোর দেয়ার কারণে কার্যকর রাজনৈতিক বা সামাজিক সমাধান বের করা কঠিন হয়। 

তদুপরি, চরমপন্থী নারীবাদের আপসহীন বা উগ্র দৃষ্টিভঙ্গি অন্যান্য নারীবাদী ধারা বা সমাজের সঙ্গে সমন্বয় করতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং, এটি শক্তিশালী বিশ্লেষণ ও আন্দোলন প্রবর্তন করেছে, কিন্তু এর প্রয়োগ ও অভিগমনে কিছু সীমাবদ্ধতা ও সমালোচনা রয়েছে।

শেষ কথা

চরমপন্থী নারীবাদ নারীবাদের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। এটি নারীবাদী আলোচনাকে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গণ্ডি থেকে সরিয়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রের কেন্দ্রে নিয়ে আসে এবং সমাজের প্রতিটি স্তরে পিতৃতান্ত্রিক ক্ষমতার বিশ্লেষণ শুরু করে।

যদিও এর কিছু দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তর্ক বিতর্ক রয়েছে এবং এটি সব নারীবাদী ধারার মতো সর্বজনগ্রাহ্য নয়, তবুও নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌনতা ও প্রজনন অধিকারের প্রশ্নে এর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চরমপন্থী নারীবাদ নিখুঁত নয়, তবে এর প্রভাব গভীর ও অনস্বীকার্য। 

Author

  • শারমিন সিমি একজন প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষিকা, যিনি বর্তমানে ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা করছেন। তিনি অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন নিজ বিভাগে কৃতিত্বের সঙ্গে। শিক্ষাদানে তাঁর গভীর ভালোবাসা ও নিষ্ঠা তাঁকে শিক্ষার্থীদের প্রিয় করে তুলেছে।

    শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তিনি ওয়েবসাইটে নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ক তথ্য, পরামর্শ এবং অনুপ্রেরণামূলক লেখা প্রকাশ করেন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *