কুমারী পূজা কেন করা হয়? জানুন কুমারী পূজার তাৎপর্য
কুমারী পূজা হিন্দু ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ আচার, যেখানে একটি কুমারী কন্যাকে দেবী দুর্গার প্রতিরূপ হিসেবে পূজা করা হয়। প্রতি বছর দুর্গাপূজার অষ্টমী বা নবমী তিথিতে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। অনেকেই জানতে চান যে কুমারী পূজা কেন করা হয়। হিন্দু বিশ্বাস মতে, কুমারী কন্যার মধ্যে দেবী শক্তির পবিত্র রূপ প্রকাশিত থাকে। তাই এই পূজার মাধ্যমে নারীশক্তির মহিমা, পবিত্রতা এবং মাতৃত্বের সম্মান প্রদর্শন করা। এর মাধ্যমে সমাজে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয় এবং ভক্তরা বিশ্বাস করেন, এই আচার তাদের জীবনে দেবীর আশীর্বাদ বয়ে আনে।
কুমারীর পায়ে পদ্ম নিবেদন করার মধ্য দিয়ে মূলত দেবী দুর্গাকেই আরাধনা করা হয়। তান্ত্রিক দর্শনে কুমারীকে সরাসরি যোগিনী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। বিভিন্ন পুরাণগ্রন্থেও কুমারী পূজার মাহাত্ম্য ও তাৎপর্যের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে এটিকে দেবী উপাসনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আজকের আর্টিকেল থেকে আপনারা কুমারী পূজার বিস্তারিত জানবেন।
আরও পড়ুনঃ গ্রামীণ সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য
কুমারী পূজা কী?
কুমারী পূজা হলো অনধিক ষোলো বছরের, অর্থাৎ রজঃস্বলা হয়নি এমন একটি বা একাধিক কুমারী মেয়েকে দেবী দুর্গা বা মহাশক্তির জীবন্ত প্রতীক হিসেবে পূজা করা। এটি সাধারণত দুর্গাপূজার মহাষ্টমীর দিনে অনুষ্ঠিত হয়, তবে কিছু স্থানে নবমীর দিনে অথবা কালীপূজা, জগদ্ধাত্রী পূজা বা অন্নপূর্ণা পূজার সময়েও এর প্রচলন আছে। পূজার জন্য নির্বাচিত শিশুকন্যাকে স্নান করিয়ে, নতুন বস্ত্র ও অলঙ্কারে সাজিয়ে মাতৃমূর্তির মতো করে দেবীর আসনে বসানো হয়। এরপর নানা মন্ত্র ও উপাচারের মাধ্যমে তাঁকে দেবী রূপে আরাধনা করা হয়।
হিন্দু দর্শন অনুসারে, সকল নারীর মধ্যেই দেবী মহাশক্তির প্রকাশ বিদ্যমান। কিন্তু কুমারী কন্যার মধ্যে তার কোনো জাগতিক বা পার্থিব আকর্ষণ না থাকায়, তার পবিত্রতা ও নিষ্পাপতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকে। তাই তাঁকে দেবী দুর্গার শুদ্ধতম রূপ হিসেবে পূজা করা হয়।
বিশ্বাস করা হয় যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় এর ত্রিশক্তি বীজাকারে কুমারীর মধ্যে বিরাজ করে। এই পূজা নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জনের পথ দেখায়। আধুনিক যুগে স্বামী বিবেকানন্দ এই পূজাকে নারী জাতির প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রতিষ্ঠার একটি মাধ্যম হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি দেন।
কুমারী পূজা কেন করা হয়?
কুমারী পূজা করার অনেক কারণ রয়েছে আর সেগুলো অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। আর যুক্তিযুক্ত কারণ আছে বলেই যুগের পর যুগ এই পূজা পালিত হয়ে আসছে। চলুন দেখে নেয়া যাক কেন পালন করা হয়েছে এই কুমারী পূজাঃ
-
দেবী দুর্গার প্রতিরূপ হিসেবে
কুমারীকে দেবীর জীবন্ত রূপ হিসেবে দেখা হয়; মানুষ বিশ্বাস করে যে সেই কন্যার মধ্যে দুর্গার আধ্যাত্মিক শক্তি অবতীর্ণ থাকে। তাই তাকে দেবীর মতো আরাধনা করলে ভক্তরা দেবীর আশীর্বাদ ও রক্ষা লাভ করবে। এটাই পূজার মৌলিক ন্যারেটিভ। এটি ধর্মীয় অনুভূতিকে জাগ্রত করার পাশাপাশি সমাজে দেবীয় সম্মানের ভাব ধারণ করে।
-
নারীশক্তির মহিমা প্রকাশে
কুমারী পূজা নারীশক্তির পবিত্রতা ও মর্যাদা উদযাপন করে। সমাজকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে নারী কেবল ঘরসংক্রান্ত নয়; তারা শক্তি, শ্রদ্ধা ও আধ্যাত্মিকতার উৎসও হতে পারে। ফলে এই পূজা নারীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি সাংস্কৃতিক পদ্ধতিও হিসেবে কাজ করে।
-
অশুভ শক্তি দমনে
ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী দেবীর আরাধনার মাধ্যমে অসৎ বা অশুভ প্রভাব কমে যায় এবং শুভ, রক্ষণশীল শক্তি বাড়ে। কুমারী পূজায় পাঠ, মন্ত্রোচ্চারণ ও উৎসর্গের মাধ্যমে কুল পরিবারে শান্তি, সৌভাগ্য ও মঙ্গল কামনা করা হয়। এই অনুশীলনটি আত্মিক নিরাপত্তা ও মানসিক শান্তিও দেওয়ার আশা জাগায়।
-
প্রকৃতির আরাধনা হিসেবে
প্রাচীন ঋষি মুনিরা প্রকৃতিকে দেবীরূপে মানতেন এবং প্রকৃতির নির্মলতা আর উর্বরতাকে নারীশক্তির সঙ্গে তুলনা করতেন। কুমারীকে প্রকৃতির এই নির্মল রূপ হিসেবে দেখেই তাঁরা তাকে পূজায় নিয়ে আসতেন, যাতে মানুষ প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। ফলে কুমারী পূজা প্রকৃতি আর মানব জীবনের সংযোগ ও কৃতজ্ঞতার এক আচার হিসেবে বিবেচিত।
-
পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে
কুমারীরা সাধারণত নিষ্কলুষ ও অনবদ্য মানসিকতার প্রতীক ধরা হয়, তাই তাদের মধ্যে দেবীর উপস্থিতি দেখার প্রথা গড়ে উঠে। পূজার মাধ্যমে ওই নির্মলতা ও পবিত্রতাকে সম্মান জানানো হয় এবং ভক্তরা মনে করেন যে পবিত্র হৃদয়ের মাধ্যমে ঈশ্বরীয় মহিমা প্রকাশ পায়। এই ধারণা পূজাকে আধ্যাত্মিক বিশুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
কুমারী পূজার কীভাবে করা হয়?

এক থেকে ষোলো বছরের মধ্যে কুমারী মেয়েদের নির্বাচন করা হয়। বয়স অনুযায়ী তাদের বিশেষ নাম দিয়ে অভিহিত করা হয়। এরপর নির্বাচিত কুমারীদেরকে পবিত্র স্থানে বসানো হয়। তাদের নতুন জামা পরানো হয়, কপালে তিলক বা চন্দনের চিহ্ন আঁকা হয় এবং গহনা বা ফুল দিয়ে সাজানো হয়। এছাড়া ধূপ, প্রদীপ, ফুল, ফল, মিষ্টি, কপাল বা অন্যান্য পূজার সামগ্রী সাজিয়ে রাখা হয়।
কুমারীদের উপস্থিতিতে দেবীর আরাধনা করা হয়। মন্ত্র পাঠ, ধূপ দাহ, প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও ফুল বা ফল অর্পণ করা হয়। কুমারীদের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত খাদ্য বা ভোগ অর্পণ করা হয়। পূজা শেষে কুমারীরা সকলকে আশীর্বাদ দেয় এবং সকল উপস্থিত ব্যক্তি তাদের থেকে আশীর্বাদ গ্রহণ করে।
কুমারী পূজার ইতিহাস
শাস্ত্রের ব্যাখ্যানুসারে কুমারী পূজার সূচনা ঘটে বানাসুর বধের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। পুরাণকথায় বলা হয়েছে, এক সময় অসুররাজ বানাসুর স্বর্গ ও মর্ত্যলোকে আধিপত্য বিস্তার করলে দেবতারা চরম বিপদের মুখে পড়েন। তখন তারা মহাকালীর শরণ নেন। দেবতাদের প্রার্থনা গ্রহণ করে দেবী কুমারীরূপে আবির্ভূত হন এবং সেই রূপে বানাসুরকে পরাস্ত ও বধ করেন। এই ঘটনার পর থেকেই মানবসমাজে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয় এবং আজও এটি দেবী আরাধনার এক বিশেষ আচার হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
শ্রীরামকৃষ্ণের মতে, কুমারীর অন্তরে শুদ্ধাত্মার মধ্য দিয়েই ভগবতীর প্রকাশ ঘটে। কুমারী পূজার মাধ্যমে আসলে নারীজাতির প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা হয়। ১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ প্রথমবারের মতো কলকাতার বেলুড় মঠে নয়জন কুমারীকে পূজা করেন।
প্রাচীন কালে ঋষি মুনিরা কুমারী পূজার মাধ্যমে প্রকৃতির আরাধনা করতেন। তাঁদের কাছে প্রকৃতি মানেই নারী, আর কুমারীর মধ্যেই সেই নারীর এক নির্মল রূপ প্রকাশিত হতো। তাঁদের বিশ্বাস ছিল, প্রতিটি মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরের এক অনন্ত শক্তি নিহিত রয়েছে, কারণ মানুষ চৈতন্যধারী। যাঁদের মন পবিত্র ও কলুষতামুক্ত, তাঁদের মধ্য দিয়ে সেই ঈশ্বরীয় শক্তি আরও স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায়।
কুমারীদের কী নামে ডাকা হয়?
এক থেকে ষোলো বছরের মধ্যে যে কোনো কুমারী মেয়েকে কুমারী পূজার জন্য নির্বাচিত করা যেতে পারে। এই পূজায় বয়সের ক্রমানুসারে কুমারী মেয়েদের বিশেষ বিশেষ নাম দিয়ে অভিহিত করা হয়। ছোট বয়সের কুমারীকে এক ধরনের নামে এবং বড় বয়সের কুমারীকে অন্য ধরনের নামে ডাকা হয়, যাতে তাদের বয়সের পর্যায় অনুযায়ী পূজার যথাযথ মর্যাদা প্রতিফলিত হয়। এই নামকরণের মাধ্যমে কুমারী পূজার প্রথা আরও সুসংগঠিত ও অর্থবহ হয়ে ওঠেঃ
- ১ বছর বয়সি কন্যাকে সন্ধ্যা
- ২ বছর বয়সি কন্যাকে সরস্বতী
- ৩ বছর বয়সি কন্যাকে কালিকা
- ৫ বছর বয়সি কন্যাকে সুভগা
- ৬ বছর বয়সি কন্যাকে উমা
- ৭ বছর বয়সি কন্যাকে মালিনী
- ৮ বছর বয়সি কন্যাকে কুব্জিকা
- ৯ বছর বয়সি কন্যাকে অপরাজিতা
- ১০ বছর বয়সি কন্যাকে কালসন্ধর্ভা
- ১১ বছর বয়সি কন্যাকে রুদ্রাণী
- ১২ বছর বয়সি কন্যাকে ভৈরবী
- ১৩ বছর বয়সি কন্যাকে মহালক্ষ্মী
- ১৪ বছর বয়সি কন্যাকে পীঠনায়িকা
- ১৫ বছর বয়সি কন্যাকে ক্ষেত্রজ্ঞা এবং
- ১৬ বছর বয়সি কন্যাকে অম্বিকা বলা হয়।
শেষ কথা
আশা করা যায় আপনারা জেনেছেন কুমারী পূজা কেন করা হয়। কুমারী পূজা এমন একটি প্রথা, যা সমাজে নারীর পবিত্রতা, শুদ্ধতা ও সৌন্দর্যের গুরুত্বকে তুলে ধরে। কুমারীকে দেবীর প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে মানুষ নারীর মর্যাদা ও সামাজিক ভূমিকার প্রতি সম্মান জানায়। এটি শিশুদের এবং যুব সমাজকে শিখায় যে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও সন্মান রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
