monmajhi kon samas

মনমাঝি কোন সমাস? ব্যাসবাক্য এবং উদাহরণ

বাংলা ভাষায় বিভিন্ন ধরনের সমাস রয়েছে – তৎপুরুষ, বহুব্রীহি, দ্বন্দ্ব, কর্মধারয়, দ্বিগু ইত্যাদি। এই লেখায় আমরা আলোচনা করবো বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ ‘মনমাঝি’ নিয়ে। প্রশ্ন হলো মনমাঝি কোন সমাস, কীভাবে এটি গঠিত, এসব বিষয় নিয়েই আমাদের বিস্তৃত আলোচনা।

আরও পড়ুনঃ যা সহজে হজম হয় এক কথায় প্রকাশ

মনমাঝি কোন সমাস? 

মনমাঝি হচ্ছে রূপক কর্মধারয় সমাস। ‘মনমাঝি’ শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে আমরা দুটি পদ পাই – মন (যাকে তুলনা করা হচ্ছে), মাঝি (যার সাথে তুলনা করা হচ্ছে)। নৌকা চালানোর জন্য যেমন একজন মাঝির প্রয়োজন হয়, তেমনি মানুষের জীবন তরি পরিচালনার জন্য ‘মন’ কাজ করে চালিকাশক্তি হিসেবে। এখানে মন এবং মাঝির মধ্যে কোনো তুলনা করা হচ্ছে না, বরং মনকেই ‘মাঝি’ হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। অর্থাৎ মন আর মাঝির মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। এটাই রূপক সমাসের সার্থকতা।

রূপক কর্মধারয় সমাস কী?

যখন উপমান (যার সাথে তুলনা করা হয়) এবং উপমেয় (যাকে তুলনা করা হয়) এই দুটির মধ্যে কোনো পার্থক্য কল্পনা না করে অভেদ কল্পনা করা হয়, তখন তাকে রূপক কর্মধারয় সমাস বলে। এখানে উপমেয় পদের সাথে উপমান পদের মিলন ঘটে এবং মাঝে ‘রূপ’ শব্দটি যোজক হিসেবে বসে। অর্থাৎ এই সমাসে সাধারণত উপমেয় পদটি থাকে আগে এবং উপমান পদটি থাকে পরে। ব্যাসবাক্য তৈরি করার সময় এই দুটি পদের মাঝখানে ‘রূপ’ শব্দটি যোগ করা হয়।

  • রূপক কর্মধারয় সমাসের উদাহরণ 
  • জীবনপ্রদীপ – জীবন রূপ প্রদীপ
  • ক্রোধানল – ক্রোধ রূপ অনল  
  • বিসাদসিন্ধু – বিসাদ রূপ সিন্ধু
  • প্রাণপাখি – প্রাণ রূপ পাখি
  • মোহনিদ্রা – মোহ রূপ নিদ্রা
  • দিলদরিয়া – দিল রূপ দরিয়া 
  • বিদ্যাধন – বিদ্যা রূপ ধন
  • শোকানল – শোক রূপ অনল
  • জ্ঞানপ্রদীপ – জ্ঞান রূপ প্রদীপ
  • যৌবনকুসুম – যৌবন রূপ কুসুম।

রূপক কর্মধারয় সমাসের বৈশিষ্ট্য

রূপক কর্মধারয় সমাসকে অন্য সমাস থেকে আলাদা করার জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিচে রূপক কর্মধারয় সমাসের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো:

  • এখানে পূর্বপদ রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়।
  • উত্তরপদ প্রকৃত বা মূল অর্থ প্রকাশ করে এবং পুরো সমাসের প্রধান অর্থ নির্ধারণ করে।
  • উপমেয় ও উপমান পদের মধ্যে কোনো পার্থক্য রাখা হয় না, বরং তাদের অভেদ কল্পনা করা হয়।
  • এ ধরনের সমাসে ভাষা হয় কাব্যিক, চিত্রধর্মী ও আবেগপূর্ণ।
  • সাধারণত বিশেষণ + বিশেষ্য মিলেই এই সমাস গঠিত হয়।
  • কবিতা, সাহিত্য ও অলঙ্কারধর্মী লেখায় এর ব্যবহার বেশি দেখা যায়।
  • এ সমাসে অর্থের ভেতরে থাকে রূপান্তরিত কল্পনা, সরাসরি তুলনা নয় বরং রূপক উপস্থাপনা।

FAQs

কেন ‘মনমাঝি’কে রূপক কর্মধারয় সমাস বলা হয়?

এখানে ‘মন’ এবং ‘মাঝি’ এর মধ্যে কোনো পার্থক্য রাখা হয়নি, বরং মনকেই মাঝি হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে। উপমান ও উপমেয় পদের অভেদ কল্পনা করা হয় বলেই এটি রূপক কর্মধারয়। এইভাবেই মনকে মাঝির সঙ্গে তুলনা না করে মাঝির রূপেই প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।

রূপক কর্মধারয় সমাসে কোন পদের অর্থ প্রধান থাকে?

সকল কর্মধারয় সমাসেই পরপদের অর্থ প্রধান হিসেবে বিবেচিত হয়। রূপক কর্মধারয় যেহেতু কর্মধারয় সমাসেরই একটি প্রকারভেদ, তাই এখানেও পরপদের অর্থের প্রাধান্য বজায় থাকে। যদিও এখানে ‘রূপ’ শব্দ দিয়ে দুটিকে এক করে ফেলা হয়, তবুও ব্যাকরণগতভাবে পরপদটিই অর্থের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

মনমাঝি শব্দটি কি কর্মধারয় সমাসের নিয়ম পূরণ করে?

হ্যাঁ, ‘মনমাঝি’ শব্দটি কর্মধারয় সমাসের ব্যাকরণিক নিয়মগুলো নিখুঁতভাবে পূরণ করে। এখানে মূল আলোচনা বা গুরুত্ব ‘মন’কে নিয়ে নয়, বরং মনকে চালনা করার জন্য যে ‘মাঝি’র মতো সত্তা প্রয়োজন, সেই সত্তাটির ওপর। অর্থাৎ, মনকে যখন মাঝির গুণে গুণান্বিত করা হচ্ছে, তখন পরপদ ‘মাঝি’র চরিত্রটিই অর্থের দিক থেকে বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। এটি কর্মধারয় সমাসের প্রথম ও প্রধান নিয়ম।

রূপক কর্মধারয় সমাস চেনার সহজ উপায় কী কী?

রূপক কর্মধারয় সমাস চেনার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো এর গঠনশৈলী লক্ষ্য করা; যেখানে সাধারণত পূর্বপদটি হয় অদৃশ্য অনুভূতিবাচক শব্দ এবং পরপদটি হয় বাস্তব কোনো বস্তু। রূপক কর্মধারয় সমাস তার অলংকারিক বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে ভাষাকে যেমন সংক্ষিপ্ত করে, তেমনি অর্থের গভীরতা ও কাব্যিক সুষমা বাড়িয়ে তোলে।

রূপক কর্মধারয় সমাসে সাধারণত পূর্বপদটি কেমন প্রকৃতির হয়?

রূপক কর্মধারয় সমাসে পূর্বপদটি সাধারণত একটি বিমূর্ত ধারণা হিসেবে প্রকাশ পায়। ব্যাকরণগতভাবে এই পূর্বপদটিকে ‘উপমেয়’ বলা হয়, যা এমন কোনো অনুভূতি বা সত্তাকে নির্দেশ করে যা চাক্ষুষ দেখা যায় না বা স্পর্শ করা যায় না, বরং কেবল মন দিয়ে উপলব্ধি করা যায়; যেমন, মন, প্রাণ, শোক, ক্রোধ, বিদ্যা বা মোহ ইত্যাদি। 

কেন রূপক কর্মধারয় সমাসে পূর্বপদ হিসেবে বিমূর্ত পদকে বেছে নেওয়া হয়? 

মূলত একটি জটিল বা অদৃশ্য ভাবকে সহজবোধ্য ও দৃশ্যমান করার জন্যই রূপক কর্মধারয় সমাসে পূর্বপদ হিসেবে বিমূর্ত পদকে বেছে নেওয়া হয় এবং ব্যাসবাক্যে ‘রূপ’ যোজকের মাধ্যমে পরপদের সঙ্গে তার অভেদ কল্পনা করা হয়।

উপসংহার

পরিশেষে বলা যায়, ‘মনমাঝি’ শব্দটি বাংলা ব্যাকরণের রূপক কর্মধারয় সমাসের একটি অনবদ্য এবং স্বার্থক উদাহরণ। ব্যাকরণিক বিচারে এটি কর্মধারয় সমাসের পরপদ প্রধান হওয়ার নিয়মটি যেমন যথাযথভাবে পালন করে, তেমনি সাহিত্যিক বিচারে মন এবং মাঝির মধ্যে অভেদ কল্পনা করে আমাদের ভাষার অলংকারিক সৌন্দর্যকে বহুগুণ বৃদ্ধি করে। মনের মতো একটি বিমূর্ত বিষয়কে মাঝির মতো একটি মূর্ত সত্তার রূপ দেয়। 

Author

  • শারমিন সিমি একজন প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষিকা, যিনি বর্তমানে ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা করছেন। তিনি অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন নিজ বিভাগে কৃতিত্বের সঙ্গে। শিক্ষাদানে তাঁর গভীর ভালোবাসা ও নিষ্ঠা তাঁকে শিক্ষার্থীদের প্রিয় করে তুলেছে।

    শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তিনি ওয়েবসাইটে নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ক তথ্য, পরামর্শ এবং অনুপ্রেরণামূলক লেখা প্রকাশ করেন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *