sodium causes fire in water

কোন ধাতু পানিতে ফেললে আগুন ধরে যায়? এর কারণ কী?

মানুষের দৈনন্দিন জীবনে পানি ও ধাতুর সংস্পর্শ একটি সাধারণ বিষয়। আমরা ঘরে, শিল্পে, ল্যাবে নানা ধাতু পানির সঙ্গে ব্যবহার করি, তবু বেশিরভাগ সময় কোনো অগ্নি বা বিস্ফোরণ ঘটে না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, কিছু নির্দিষ্ট ধাতু পানিতে পড়লেই ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া ঘটে এবং মুহূর্তের মধ্যেই আগুন ধরে যায়। এই ঘটনা একদিকে যেমন বিস্ময়কর, তেমনি এটি রাসায়নিক বিজ্ঞানের এক চমৎকার উদাহরণ।

তাই আপনি যদি জানতে চান কোন ধাতু পানিতে ফেললে আগুন ধরে যায়, তাহলে উত্তর হচ্ছে অ্যালকালি ধাতু। এই ধাতুগুলো এতটাই সক্রিয় যে, এরা পানির সংস্পর্শে আসামাত্রই তীব্র বিক্রিয়া করে এবং উৎপন্ন তাপে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই ধাতুগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত হলো সোডিয়াম (Na)।

আরও পড়ুনঃ ইসলামের প্রথম যুদ্ধের নাম কি?

সোডিয়াম কেন পানি ফেললে আগুন ধরে যায়?

সোডিয়াম পানি ফেললে আগুন কেন ধরে সে প্রশ্ন অনেকেরই থাকতে পারে। আসলে সোডিয়াম পানিতে ফেলার পর এমন কিছু ঘটে যা একটি বিপজ্জনক আগুনের সৃষ্টি করে। 

  • সোডিয়াম একটি অত্যন্ত সক্রিয় ধাতু

সোডিয়াম (Na) এর বৈশিষ্ট্য হলো, তাদের বাইরের খোলে একটি মাত্র ইলেকট্রন থাকে, যা তারা খুব সহজেই হারাতে সক্ষম। এই কারণে সোডিয়াম অন্যান্য পদার্থের সঙ্গে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে বিক্রিয়া করে। বিশেষত, পানি বা আর্দ্র পরিবেশের সঙ্গে এটি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং প্রচুর তাপ উৎপন্ন করে।

  • পানির সাথে রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া ঘটে

যখন সোডিয়াম পানিতে ফেলা হয়, তখন এটি পানির অণুর (H₂O) সঙ্গে বিক্রিয়া করে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড (NaOH) এবং হাইড্রোজেন গ্যাস (H₂) উৎপন্ন করে। এই প্রতিক্রিয়ার রাসায়নিক সমীকরণ হলো: 2Na + 2H₂O → 2NaOH + H₂ + তাপ। এই বিক্রিয়ায় প্রচুর পরিমাণ তাপ নির্গত হয়, যা পরবর্তী ধাপে আগুন ধরে যাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

  • হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন হয় যেটা দাহ্য

সোডিয়াম-পানির প্রতিক্রিয়ায় যে হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপন্ন হয়, তা খুবই দাহ্য। হাইড্রোজেন অল্প তাপ পেলে সহজেই আগুন ধরে ফেলে। সোডিয়ামের সঙ্গে পানির বিক্রিয়ার সময় যে তাপ উৎপন্ন হয়, তা হাইড্রোজেনকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জ্বালিয়ে তোলে, ফলে আগুনের সৃষ্টি ঘটে।

  • সোডিয়াম তরল আকারে প্রতিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে

প্রতিক্রিয়ার সময় সোডিয়াম নিজেই তাপে গলে যায় এবং পানি পৃষ্ঠে ভেসে থাকে। গলিত সোডিয়াম ক্রমাগত নড়াচড়া করে, আরও বেশি পানি স্পর্শ করে এবং প্রতিক্রিয়াকে দ্রুততর করে। ফলে তাপ উৎপাদন, হাইড্রোজেন নির্গমন এবং আগুন ধরার প্রক্রিয়াগুলো একসঙ্গে দ্রুত ঘটে।

  • অতিরিক্ত তাপ তৈরি করে 

প্রতিক্রিয়ায় সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড (NaOH) তৈরি হয়, যা শক্তিশালী ক্ষার। NaOH পানির সঙ্গে দ্রবীভূত হওয়ার সময়ও অতিরিক্ত তাপ উৎপন্ন করে। এই তাপ আগুনের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দেয় এবং প্রতিক্রিয়াকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।

সোডিয়াম কি শুধুমাত্র পানির সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখায়, নাকি অন্য পদার্থের সঙ্গেও? 

Sodium reactions

সোডিয়াম পানি ছাড়াও আরও কয়েকটি পদার্থের সাথেও প্রতিক্রিয়া করে। এটি আর কোন কোন পদার্থের সাথে প্রতিক্রিয়া করে তা নিচে দেয়া হলোঃ 

অ্যাসিডঃ সোডিয়াম শুধু পানির সঙ্গে নয়, শক্ত অ্যাসিডের সাথেও প্রতিক্রিয়া করে। প্রতিক্রিয়াটি এতই সক্রিয় যে উৎপন্ন হাইড্রোজেন গ্যাস দাহ্য হতে পারে এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রচুর তাপও সৃষ্টি হয়। 

অক্সিজেনঃ বাতাসে থাকা অক্সিজেনের সঙ্গে সোডিয়ামের সংস্পর্শে আসা মাত্রই এটি অক্সাইড তৈরি করতে শুরু করে।

হ্যালোজেনঃ প্রতিক্রিয়াটি অত্যন্ত সক্রিয় এবং সাধারণত দ্রুত ঘটে, কারণ সোডিয়ামের একটি বাইরের ইলেকট্রন সহজেই হ্যালোজেনের সঙ্গে বিনিময় করে লবণ গঠন করে।

FAQs

সোডিয়াম পানির বিক্রিয়াটি কী ধরনের প্রতিক্রিয়া?

সোডিয়াম পানির বিক্রিয়াটি একটি উষ্মাশোষী প্রতিক্রিয়া। এই বিক্রিয়ার রাসায়নিক সমীকরণ হলো:

2Na + 2H₂O → 2NaOH + H₂ + তাপ

বিক্রিয়ার সময় যে তাপ উৎপন্ন হয়, তা এত বেশি যে আশেপাশের পানি দ্রুত উত্তপ্ত হয় এবং উৎপন্ন হাইড্রোজেন গ্যাসকে নিজে থেকেই জ্বলে ওঠার জন্য পর্যাপ্ত শক্তি দেয়। এ কারণে, হাইড্রোজেনের আগুন ধরার প্রক্রিয়াটি স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটে।

সোডিয়াম যখন জ্বলে ওঠে তখন আগুনের রঙ কেমন হয়? 

সোডিয়াম ধাতু যখন জ্বলে, তখন আগুনের রঙ হয় হলুদচে বা হালকা কমলা।এর কারণ হলো সোডিয়াম পরমাণুর ইলেকট্রন তাপের কারণে উচ্চ শক্তিস্তরে উঠে গিয়ে পরে নিচে ফিরে আসার সময় নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো নির্গত করে, যা চোখে হলুদ শিখা হিসেবে দেখা যায়।

সোডিয়াম পানিতে বিক্রিয়া করে যে আগুন তৈরি করে তা কি বিপজ্জনক?

সোডিয়াম ও পানির প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত দ্রুত ও তীব্র। যদি একটু বড় টুকরা সোডিয়াম পানিতে ফেলা হয়, তাহলে বিস্ফোরণও ঘটতে পারে। তাছাড়া উৎপন্ন সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড একটি ক্ষারজাত পদার্থ, যা ত্বকের সংস্পর্শে এলে দাহ সৃষ্টি করে। ফলে হাইড্রোজেন গ্যাস জ্বলে বা বিস্ফোরিত হয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। তাই এই পরীক্ষাটি কেবল ল্যাবরেটরিতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে, অল্প পরিমাণ সোডিয়াম ব্যবহার করে করাই নিরাপদ। 

বিক্রিয়ার সময় সোডিয়াম গলে যাওয়া প্রতিক্রিয়ার তীব্রতাকে কিভাবে প্রভাবিত করে?

যখন সোডিয়াম পানির সঙ্গে প্রতিক্রিয়া শুরু করে, তখন এটি তাপের কারণে গলতে থাকে এবং তরল আকারে পানি পৃষ্ঠে ভেসে ওঠে। গলিত সোডিয়াম ক্রমাগত নড়াচড়া করে এবং পানির সঙ্গে আরও বেশি সংস্পর্শে আসে। এর ফলে প্রতিক্রিয়ার জন্য নতুন স্থান সৃষ্টি হয়, যা প্রতিক্রিয়াকে দ্রুত এবং বেশি তীব্র করে তোলে। এই উত্তাপ হাইড্রোজেনকে সহজেই দাহ্য করে তোলে, যার ফলে আগুনের তীব্রতা অনেক বৃদ্ধি পায়। 

কেরোসিনে সোডিয়াম সংরক্ষণের বৈজ্ঞানিক কারণ কী?

সোডিয়াম নিরাপদভাবে সংরক্ষণের জন্য সোডিয়ামকে কেরোসিনে রাখা হয়। কেরোসিনে পানি থাকে না, ফলে সোডিয়াম বাতাসের আর্দ্রতা বা পানির সঙ্গে কোনো সংস্পর্শে আসে না এবং প্রতিক্রিয়া শুরু হয় না। এছাড়াও কেরোসিন সোডিয়ামকে বাতাসের অক্সিজেন থেকেও রক্ষা করে। এই কারণে কেরোসিনে রাখা সোডিয়াম দীর্ঘ সময় ধরে স্থিতিশীল থাকে এবং ব্যবহার করার সময়ও নিরাপদ থাকে। 

শেষ কথা

সব ধাতু একরকম নয়। কেউ স্থিতিশীল, কেউ অতি প্রতিক্রিয়াশীল। আলকালি ধাতুসমূহ, বিশেষ করে সোডিয়াম, পটাসিয়াম, রুবিডিয়াম ও সিজিয়াম পানির সঙ্গে তীব্র প্রতিক্রিয়া করে আগুন সৃষ্টি করে যা প্রমাণ করে কত শক্তিশালী হতে পারে একটি ছোট ধাতুর পরমাণু।

তবে এ ধরনের প্রতিক্রিয়া একদমই মজার খেলা নয়; এটি এক ধরনের বিপজ্জনক রাসায়নিক বিস্ফোরণ, যা কেবল প্রশিক্ষিত বিজ্ঞানীর তত্ত্বাবধানে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। বিজ্ঞান শেখার জন্য এটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি নিরাপত্তা রক্ষা করাও সমান প্রয়োজনীয়।

Author

  • শারমিন সিমি একজন প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষিকা, যিনি বর্তমানে ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা করছেন। তিনি অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন নিজ বিভাগে কৃতিত্বের সঙ্গে। শিক্ষাদানে তাঁর গভীর ভালোবাসা ও নিষ্ঠা তাঁকে শিক্ষার্থীদের প্রিয় করে তুলেছে।

    শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তিনি ওয়েবসাইটে নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ক তথ্য, পরামর্শ এবং অনুপ্রেরণামূলক লেখা প্রকাশ করেন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *