উল্কা বৃষ্টি কাকে বলে? উল্কা বৃষ্টি কেন হয় আর কখন হয়?
উল্কা বৃষ্টির নাম শোনেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবেনা। হয়তো স্বচক্ষে অনেকেই দেখেননি, তবে নাম নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। আবার নাম জানা থাকলেও অনেকেই জানেন না যে আসলেই কি এই উল্কা বৃষ্টি, আর কেনই বা হয়। এইসব প্রশ্নের উত্তর জানার আগে জেনে নিতে হবে উল্কা বৃষ্টি কাকে বলে। উল্কা বৃষ্টি তখনই দেখা যায় যখন পৃথিবী মহাকাশে ভেসে থাকা ধূমকেতু বা গ্রহাণুর ভাঙা টুকরো, ধুলো কিংবা ছোট ছোট কণার মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করে। এই কণাগুলো যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, তখন বায়ুর সঙ্গে তীব্র ঘর্ষণের ফলে জ্বলতে শুরু করে।
ফলে আকাশে উজ্জ্বল আলোর রেখার মতো ঝলক দেখা দেয়, যাকে আমরা উল্কা বৃষ্টি বলি। তবে আমরা শুধু আপনাদেরকে এতটুকুই জানাতে চাইনা, আমরা চাই আপনারা এই মহাজাগতিক ঘটনা সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানুন। তাই উল্কা বৃষ্টি সম্পর্কে আপনাদের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিতেই আমাদের আজকের আর্টিকেলটি। এখানে আমরা উল্কা বৃষ্টি সম্পর্কে আপনাদের অজানা সব দেওয়ার চেষ্টা করবো।
আরও পড়ুনঃ স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ও নিরাপদ পানির গুরুত্ব
উল্কা কি এবং উল্কা বৃষ্টি কাকে বলে?
অনেক সময় রাতের আকাশে আপনারা দেখে থাকবেন যে হঠাৎ করে আগুনের ছোট একটি গোলা দ্রুত ছুটে যাচ্ছে যেগুলোকে দেখে মনে হয় যে তারা ছএক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছে। কিন্তু আসলে এগুলো তারা নয়, এদের বলা হয় উল্কা। মহাশূন্যে ভাসমান অতিক্ষুদ্র গ্রহগত শিলাখণ্ড পৃথিবীর কাছাকাছি চলে এলে পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের কারণে প্রবল গতিতে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে।
বায়ুর সঙ্গে প্রচণ্ড ঘর্ষণের ফলে এগুলো উত্তপ্ত হয়ে জ্বলে ওঠে এবং বেশিরভাগ সময়ই পৃথিবীর মাটিতে পড়ার আগেই নিভে যায়। সাধারণত এই উল্কাগুলো আকারে অতি সূক্ষ্ম ধূলিকণা থেকে শুরু করে প্রায় ১ মিটার দৈর্ঘ্যের হয়ে থাকে। অধিকাংশ উল্কাই ধূমকেতু বা গ্রহাণুর অংশবিশেষ। রাতের আকাশে এই আলোকরেখাকে অনেকে “শুটিং স্টার” নামে চেনে।
ধূমকেতু বা গ্রহাণু যখন সূর্যের চারপাশে ঘোরে, তখন তারা নিজেদের কক্ষপথে প্রচুর ধূলিকণা ও ক্ষুদ্র শিলাখণ্ড ফেলে যায়। পৃথিবী যখন তার নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে এই ধূলিকণার স্তরের মধ্যে প্রবেশ করে, তখন অসংখ্য উল্কা একই সময়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে ঘর্ষণের কারণে জ্বলে ওঠে। এর ফলেই একসাথে প্রচুর উল্কা আকাশে আলোর রেখার মতো ছুটে যেতে দেখা যায়, যাকে বলা হয় উল্কাবৃষ্টি।
প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে উল্কা বৃষ্টি কেন দেখা যায়?
পৃথিবী প্রতি বছর সূর্যের চারপাশে নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘোরে। এই কক্ষপথের সাথে যদি ধূমকেতু ভ্রমণের সময় ফেলে যাওয়া ধূলিকণা বা ক্ষুদ্র টুকরার রেখা মিলে যায়, তাহলে পৃথিবী সেই ধূলোর স্তরের মধ্যে প্রবেশ করে। তখন অসংখ্য ক্ষুদ্র কণা প্রবল বেগে, প্রায় সেকেন্ডে ৭০ কিলোমিটার গতিতে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে পড়ে। বায়ুমণ্ডলের সাথে তীব্র ঘর্ষণের কারণে এই কণাগুলো হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে আগুনের মতো জ্বলে ওঠে।
যখন একই সময়ে অনেকগুলো উল্কা একসাথে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে এবং আকাশে অসংখ্য আলোর রেখা ছুটে যেতে দেখা যায়, তখন সেটাই উল্কাবৃষ্টি নামে পরিচিত হয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ধূমকেতুর ফেলে যাওয়া এই ধূলিকণার রেখা মহাশূন্যে স্থায়ীভাবে এক পথে অবস্থান করে। তাই প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবী সেই পথে প্রবেশ করলে একই ধরনের উল্কাবৃষ্টি দেখা যায়।
উল্কা বৃষ্টি কখন ও কিভাবে দেখা যায়?

উল্কা বৃষ্টি কোথা থেকে দেখা যাবে সেটা আগে থেকেই জানা যায়। প্রতি বছর আগস্ট মাসেই মূলত দেখা যায় এই উল্কা বৃষ্টি। এখন ইন্টারনেট বা খবরের মাধ্যমে আমাদেরকে আগে থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয় যে কোন এলাকা থেকে দেখা যাবে এই উল্কা বৃষ্টি। উল্কা বৃষ্টি দেখার সেরা সময় হচ্ছে গভীর রাত, অর্থাৎ এটি যদি রাত ৩ টার আশেপাশে হয় তাহলে খুব ভালোভাবে দেখা যায়। মূলত রাত ১২ টার পর থেকেই উল্কা বৃষ্টি সক্রিয় হতে শুরু করে এবং রাত যত গভীর হতে থাকে এই বৃষ্টিও ততো সুস্পষ্ট দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়তে থাকে।
উল্কা বৃষ্টি দেখতে হলে আপনাকে রাতের সবচেয়ে আন্ধকার জায়গাটি বেছে নিতে হবে, তবে জায়গাটি ফাঁকা অর্থাৎ খোলা উঠান বা মাঠ হলে সবথেকে ভালো হয়। আশেপাশে যত কম গাছপালা থাকবে ততই ভালো। এটি দেখতে আপনাকে বেশ উঁচুতে দাঁড়াতে হবে যাতে পাশে থাকা কোন বিল্ডিং বা গাছ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করতে পারে।
উল্কাবৃষ্টি পর্যবেক্ষণের সময় প্রথমেই আকাশে এর নির্দিষ্ট উৎসস্থল বা রেডিয়েন্ট খুঁজে বের করতে হয়। এজন্য একটি তারামণ্ডল মানচিত্র সঙ্গে রাখা খুবই উপকারী। মানচিত্রকে আকাশের সঙ্গে মিলিয়ে নিলে সহজেই বোঝা যায় কোন দিক থেকে উল্কাগুলো ছুটে আসছে। সাধারণ আলো ব্যবহার করলে চোখ ঝলসে যেতে পারে, তাই এই কাজের জন্য লাল আলো ব্যবহার করা সবচেয়ে ভালো, কারণ এটি চোখকে অন্ধকারের সাথে দ্রুত মানিয়ে নিতে সাহায্য করে এবং রেডিয়েন্ট শনাক্ত করতে সুবিধা হয়।
উল্কাবৃষ্টি কি ক্ষতিকারক?
উল্কা বৃষ্টি মোটেও বিপজ্জনক নয় কারণ এটি আকাশে দেখা গেলেও এটি কখনও পৃথিবীর কারো গায়ে এসে পড়েনা। এটি বায়ুমণ্ডলেই সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হয়ে যায়। শুধু মানুষ কেন, পৃথিবীর কোন কিছুই এই উল্কা বৃষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়না। আমরা শুধু এগুলোকে দূর থেকে দেখতে পাই।
তবে বড় বড় টুকরো গুলো কখনও কখনও মাটিতে এসে পড়তে পারে। খুবই বিরল ক্ষেত্রে এই বড় আকারের উল্কাপিণ্ড পৃথিবীর মাটিতে পৌঁছাতে পারে। কিন্তু উল্কাবৃষ্টি যেহেতু মূলত ছোট ছোট কণা দিয়ে গঠিত, তাই এটি মানুষের জীবন, পরিবেশ বা পৃথিবীর জন্য কোনো বড় ক্ষতির কারণ হয় না। এটিকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
FAQs
আকাশে উল্কা বৃষ্টি দেখতে কেমন লাগে?
আকাশে উল্কাবৃষ্টি দেখা একেবারে মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা। মনে হয় যেন রাতের অন্ধকার আকাশ থেকে অসংখ্য উজ্জ্বল আলোর রেখা বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ছে। উল্কাবৃষ্টি উপভোগ করার জন্য রাতের গভীর সময় সবচেয়ে উপযুক্ত, যখন আকাশ পুরোপুরি অন্ধকার এবং চাঁদ দেখা যায় না। শহরের আলো থেকে দূরে, কোনো খোলা ও পরিষ্কার স্থানে দাঁড়ালে এই জ্যোতির্ময় দৃশ্য সবচেয়ে সুন্দরভাবে দেখা যায়। এটি সত্যিই এক অসাধারণ প্রাকৃতিক দৃশ্য যা খুব কম লোকই উপভোগ করতে পারেন।
উল্কা বৃষ্টি এবং সাধারণ উল্কার মধ্যে পার্থক্য কী?
একটি সাধারণ উল্কা হলো মহাকাশে থাকা একটি ক্ষুদ্র কণা বা শিলাখণ্ডের একক ঘটনা, যা যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে ঘর্ষণের কারণে উত্তপ্ত হয়ে জ্বলতে থাকে এবং আকাশে উজ্জ্বল আলোর রেখা তৈরি করে। অন্যদিকে, উল্কাবৃষ্টি ঘটে তখন, যখন পৃথিবী মহাকাশে এমন একটি স্থায়ী ধূলিকণা বা ধ্বংসাবশেষের স্তরের মধ্য দিয়ে চলে যায়, যেখানে অসংখ্য ক্ষুদ্র কণা একই সময়ে প্রবেশ করে। এর ফলে একসাথে বহু উল্কা আকাশে ছুটে যেতে দেখা যায়, যা রাতের আকাশে একটি বৃষ্টির মতো উজ্জ্বল আলোর দৃশ্যমানতা তৈরি করে।
উল্কা বৃষ্টি কতদিন পরপর দেখা যায়?
প্রতি বছরই নির্দিষ্ট কিছু সময়ে উল্কা বৃষ্টি দেখা যায়। সাধারণত প্রতিটি উল্কাবৃষ্টি নির্দিষ্ট কয়েকদিন ধরে চলে। কিছু উল্কাবৃষ্টি মাত্র ১ থেকে ২ দিন, আবার কিছু উল্কাবৃষ্টি ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত দেখা যায়। তবে সবচেয়ে সুন্দর এবং বেশি উল্কা দেখা যায় সেই নির্ধারিত দিনের রাতগুলোতে।
উল্কা বৃষ্টিতে কয়টি উল্কা দেখা যায়?
উল্কা বৃষ্টির সময় ঠিক কতটি উল্কা দেখা যাবে তা বলা কঠিন। কেউ পরিমাণে কম দেখেন আবার কেউ বা বেশি। কখনও কখনও ঘণ্টায় ৫০ থেকে ৬০ টি উল্কা দেখতে পাওয়া যায়, আবার কখনও এই পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যায়। যেমন এ বছর ১২ ও ১৩ আগস্ট উল্কা বৃষ্টি হয় যেখানে বলা হয় যে প্রতি ঘণ্টায় আকাশ থেকে দেখা যাবে প্রায় ১০০ টি থেকে ১২০ টি উল্কা। তাহলে চিন্তা করুন দৃশ্যটি কত চমৎকার ছিলো! বাংলাদেশ থেকেও দেখা গিয়েছিলো এই উল্কা বৃষ্টি।
শেষ কথা
আশা করছি, উল্কা বৃষ্টি সম্পর্কে আপনারা যথেষ্ট তথ্য পেয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। উল্কা বৃষ্টির কথা বিভিন্ন সময়ে খবরে বা মোবাইলে দেখা যায় কিন্তু কি এই উল্কা বৃষ্টি তা জানেন না অনেকেই। কেউ কেউ তো আবার মনে করে থাকেন যে উল্কা বৃষ্টি ভয়ংকর কিছু। আসলে তেমন কিছুই নয়, বরং এটি একটি অত্যন্ত উপভোগ্য জিনিস। আপনার এলাকা থেকে যদি বছরের এই নির্ধারিত সময়ে উল্কা বৃষ্টি দেখা যায় তাহলে দেখতে মিস করবেন না। উল্কা এবগ উল্কা বৃষ্টি সম্পর্কে আর কোন জিজ্ঞাসা থাকলে এখনই কমেন্ট করুন।
