কম্পিউটার ভাইরাস কি? ভাইরাস কত প্রকার এবং এর থেকে বাঁচার উপায় কী?
কম্পিউটার ভাইরাস কি? কম্পিউটার ভাইরাস হলো এক ধরনের ক্ষতিকারক প্রোগ্রাম, যা কোনো কম্পিউটার সিস্টেমে প্রবেশ করার পর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন সমস্যার সৃষ্টি করে। এটি মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়া ভাইরাসের মতোই কম্পিউটারের ভেতরে কাজ করে। এই ভাইরাস সাধারণত ফাইল, ইন্টারনেট, ই-মেইল বা পেনড্রাইভের মাধ্যমে ভাইরাস ছড়িয়ে থাকে। এ কারণে কম্পিউটারের গতি কমে যায়, তথ্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে এমনকি অনেক সময় পুরো সিস্টেম অচল হয়ে যায়। তাই ব্যবহারকারীদের সবসময় সতর্ক থাকতে হবে।
আজকে আমরা আপনাদেরকে কম্পিউটার ভাইরাস সম্পর্কে জানাবো। এই ভাইরাস কী, কেন কম্পিউটার ভাইরাসে আক্রান্ত হয় এবং কিভাবে কম্পিউটারকে ভাইরাস মুক্ত করা যায় – এইসব কিছু সম্পর্কে একটু বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করবো। তাই এই লেখাটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে হবে আপনাদেরকে যদি চান আপনার কম্পিউটারটি ভাইরাস দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
Read also: উল্কা বৃষ্টি কাকে বলে?
কম্পিউটার ভাইরাস কত প্রকার ও কী কী?
ভাইরাসের ধরন অনেক হলেও, কিছু বিশেষ প্রকারের কম্পিউটার ভাইরাস আছে যা সরাসরি ব্যবহারকারীর কম্পিউটারে ক্ষতি করতে সক্ষম। এগুলো হলো:
-
Worms
এই ধরনের ভাইরাস নিজে থেকেই নিজের কপি তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ, এগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে কম্পিউটারের মধ্যে ছড়ায় এবং ধীরে ধীরে সিস্টেমের অন্যান্য অংশকে সংক্রমিত করে। ওয়ার্মের কোড এমনভাবে পরিবর্তিত হয় যে, এন্টিভাইরাস দ্বারা সনাক্ত করা অনেক কঠিন হয়ে যায়।
-
Trojans
এই ভাইরাসগুলো সাধারণত হ্যাকারদের দ্বারা ছড়ানো হয়। এটি নিজেকে সাধারণ বা সহায়ক সফটওয়্যার হিসেবে দেখায়, কিন্তু আসলে হ্যাকারদের কম্পিউটারে প্রবেশের পথ খুলে দেয়। এর মাধ্যমে হ্যাকাররা ব্যবহারকারীর তথ্য যেমন পাসওয়ার্ড, ব্যাংক তথ্য ইত্যাদি চুরি করতে পারে।
-
Malware
এই ধরনের ভাইরাস তৈরি করা হয় কম্পিউটারকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য। সাধারণত এগুলো অন্য কম্পিউটার থেকে ফাইল কপি করার সময় বা ইনফেক্টেড USB ডিভাইস ব্যবহার করার মাধ্যমে আপনার সিস্টেমে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে ক্ষতি শুরু করে।
-
Spyware
স্পাইওয়্যার ভাইরাস ব্যবহার করে আপনার কম্পিউটার ও ব্রাউজার ব্যবহারের উপর নজর রাখা হয়। এটি সাধারণত ইন্টারনেট থেকে সিস্টেমে প্রবেশ করে এবং ব্যবহারকারীর কার্যকলাপ, পাসওয়ার্ড বা অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্য গোপনভাবে সংগ্রহ করে।
-
Adware Virus
এই ভাইরাস সাধারণত ইন্টারনেট থেকে কিছু ডাউনলোড করার সময় কম্পিউটারে প্রবেশ করে। একবার ইনস্টল হলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখাতে থাকে এবং ব্যবহারকারী তা বন্ধ করতে পারলেও প্রায়শই বিজ্ঞাপন চলতেই থাকে।
-
Browser Hijackers
এই ধরনের ভাইরাস সাধারণত ইন্টারনেট থেকে কোনো ফাইল ডাউনলোড করার সময় সিস্টেমে প্রবেশ করে। এগুলো প্রায়ই সেই ডাউনলোড করা ফাইলের সঙ্গে “প্লাগইন” বা “এক্সটেনশন” হিসেবে লুকিয়ে থাকে এবং এইভাবে আপনার কম্পিউটারে প্রবেশ করে।
-
Overwrite Viruses
এই ভাইরাসগুলো কম্পিউটারে প্রবেশ করে সিস্টেম ফাইল বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ফাইল মুছে দিতে পারে। এছাড়াও, এগুলো মুছে ফেলা ফাইলের জায়গায় নিজের ক্ষতিকর কোড বসিয়ে সিস্টেমে ধীরে ধীরে ক্ষতি করে।
কম্পিউটার ভাইরাস কীভাবে এর মধ্যে প্রবেশ করে?
অধিকাংশ কম্পিউটার ভাইরাস ইন্টারনেটের মাধ্যমেই ছড়িয়ে পড়ে। এটি হতে পারে অবিশ্বস্ত কোনো ওয়েবসাইট থেকে ফাইল বা সফটওয়্যার ডাউনলোড করার কারণে, কিংবা সংক্রমিত ওয়েবসাইটে প্রবেশ করার মাধ্যমে।
অনেক সময় আমরা নিজের বা অন্য কারো USB ডিভাইস ব্যবহার করি এবং ফাইল আদান প্রদান করি। যদি সেই USB ডিভাইস ভাইরাস আক্রান্ত থাকে, তবে খুব সহজেই তা আমাদের কম্পিউটারেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাছাড়া, প্রতিদিন আমরা বিভিন্ন উৎস থেকে অসংখ্য ইমেইল পাই। এসব মেইলের সঙ্গে যুক্ত ফাইল বা অ্যাটাচমেন্ট অজান্তেই খুলে ফেললে কম্পিউটার ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
কিভাবে বুঝবেন আপনার কম্পিউটার ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত?
যদিও কম্পিউটার ভাইরাস সাধারণত অদৃশ্যভাবে কাজ করে, তবুও এর মূল উদ্দেশ্য যেহেতু ব্যবহারকারীর ক্ষতি করা, তাই কিছু লক্ষণ থেকে সহজেই বোঝা যায় কম্পিউটার ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে কিনা। চলুন জেনে নেওয়া যাক কম্পিউটার ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কিছু সাধারণ লক্ষণঃ
-
কম্পিউটার ধীরগতির হয়ে যাওয়া
কখনও কখনও হঠাৎ কম্পিউটার চালাতে গিয়ে দেখবেন যে এটি খুব স্লো হয়ে গিয়েছে অথবা সফটওয়্যার গুলো কাজ করতে অনেকটা সময় নিচ্ছে। এটি ভাইরাসে আক্রান্ত হবার খুব সাধারণ একটি লক্ষণ। ভাইরাস background এ অনেক কাজ করে ফলে সমগ্র কম্পিউটারের কার্যক্রম ধীর গতির হয়ে যায়।
-
এরর (error) মেসেজ আসা
আপনি যদি কম্পিউটারে কাজ করতে করতে বারবার বিভিন্ন error ম্যাসেজ দেখতে পান তাহলে এটি ইঙ্গিত করে যে আপনার ডিভাইসটি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে আপনার ডিভাইসই আপনাকে ম্যাসেজ দেয় যে কোথাও কোন একটা সমস্যা হচ্ছে।
-
অ্যাপ্লিকেশন ক্র্যাশ হওয়া
কোনো ফাইল খোলার সময় যদি বারবার কম্পিউটার হ্যাং করে, অ্যাপ্লিকেশন নিজে থেকে বন্ধ হয়ে যায় বা হঠাৎ ব্লুস্ক্রিন দেখায়, তবে এটি ভাইরাসের লক্ষণ হতে পারে। কিছু ভাইরাস ইচ্ছাকৃতভাবে সিস্টেম ফাইল নষ্ট করে বা ক্ষতিগ্রস্ত করে, আবার কিছু ভাইরাস নিজেকে ফাইলের ভেতরে লুকিয়ে রেখে ধীরে ধীরে কম্পিউটারের কাজ ব্যাহত করে।
-
অপ্রয়োজনীয় ফাইল তৈরি হওয়া
আপনি নিজে কোনো সফটওয়্যার ইন্সটল না করলেও হঠাৎ নতুন প্রোগ্রাম, ফাইল বা শর্টকাট দেখা দিলে এটি ভাইরাসের লক্ষণ হতে পারে। বিশেষ করে USB ডিভাইস ব্যবহার করলে সেখানে লুকানো .exe বা autorun ফাইল কম্পিউটারে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। ভাইরাস এই প্রক্রিয়াটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করে।
-
হঠাৎ প্রয়োজনীয় ফাইল হারিয়ে যাওয়া
কম্পিউটারে ভাইরাসের সংক্রমণ হলে আপনার কিছু প্রয়োজনীয় ফাইল নিজে নিজেই হারিয়ে যেতে পারে বা স্থায়ীভাবে মুছে যেতে পারে। এটি আপনার অজান্তেই হবে। আপনি কোন দরকারি ফাইল খুঁজতে গিয়ে দেখবেন যে সেটি কোথাও নেই।
-
কম্পিউটার নিজে নিজে Restart নেয়া
আপনি কাজ করছেন, হঠাৎ কম্পিউটার নিজেই রিস্টার্ট নিচ্ছে। আপনি ভাবলেন এটি স্বাভাবিক। কিছুক্ষণ পর দেখলেন আবার একইভাবে কম্পিউটার রিস্টার্ট হচ্ছে। এটি নিশ্চিতভাবে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ। ভিতরে ভাইরাস ঢুকে আপনার প্রোগ্রামকে বাঁধাগ্রস্ত করছে, তাই এটি বারবার restart নিচ্ছে।
-
ইন্টারনেট গতি কমে যাওয়া
কম্পিউটারের ইন্টারনেট যদি হঠাৎ অস্বাভাবিকভাবে ধীর হয়ে যায়, তবে তার একটি প্রধান কারণ হতে পারে ভাইরাস। এই প্রক্রিয়ায় ভাইরাস ইন্টারনেটের ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করে, যার ফলে ওয়েবসার্ফিং, ভিডিও স্ট্রিমিং বা ফাইল ডাউনলোডের স্পিড অনেক কমে যেতে পারে। এর ফলে ব্যবহারকারী সহজেই বুঝতে পারেন যে কম্পিউটার স্বাভাবিকের মতো কাজ করছে না এবং ভাইরাসের উপস্থিতি আছে।
ভাইরাস কম্পিউটারের কী কী ক্ষতি করে?
কম্পিউটার ভাইরাস অনেক ধরনের ক্ষতি করতে পারে। প্রথমত, এটি কম্পিউটারের CPU ও RAM ব্যবহার করে ব্যাকগ্রাউন্ডে কাজ চালায়, যার ফলে সিস্টেম ধীরগতির হয়ে যায় বা কখনো কখনো সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কিছু ভাইরাস গুরুত্বপূর্ণ ফাইল, ডকুমেন্ট বা ছবি সরাসরি নষ্ট করে, আবার কিছু ফাইল লুকিয়ে রেখে রিকভারি কঠিন করে তোলে।
ভাইরাসের কারণে অ্যাপ্লিকেশন বারবার হ্যাং বা ক্র্যাশ করতে পারে। কিছু ভাইরাস অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার নিষ্ক্রিয় করে দেয়, যা সিস্টেমকে আরও সংবেদনশীল করে তোলে। এছাড়া, ভাইরাস ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করতে পারে। কিছু ভাইরাস আবার ব্যবহারকারীর অজান্তে ইমেইল বা সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট ব্যবহার করে স্প্যাম পাঠায়, যার ফলে ভাইরাস আরও ছড়িয়ে পড়ে।
কম্পিউটার ভাইরাস প্রতিরোধের উপায় কী কী?
কম্পিউটার ভাইরাস প্রতিরোধ করার বেশকিছু উপায় রয়েছে। সতর্ক থাকার পরও দেখা যায় যে ভাইরাস ঠিকই আক্রমণ করেছে। প্রতিরোধের উপায়গুলো জানা থাকলে আপনি ভাইরাসের আক্রমণকে ঠেকাতে পারবেন। অনিচ্ছাকৃতভাবে ভাইরাসের আক্রমণে পড়া স্বাভাবিক। যদি এমন পরিস্থিতি ঘটে, তবে কী করতে হবে তা জেনে নিনঃ
- সবসময় বিশ্বস্ত উৎস থেকে সফটওয়্যার, ফাইল ও অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোড করুন
- এন্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করুন এবং তা নিয়মিত আপডেট রাখুন, যাতে নতুন ধরনের ভাইরাসও সনাক্ত ও প্রতিরোধ করা যায়।
- USB বা অন্যান্য ডিভাইস ব্যবহার করার আগে তা স্ক্যান করা উচিত, কারণ অনেক সময় সংক্রমিত ডিভাইসের মাধ্যমে ভাইরাস সহজেই কম্পিউটারে প্রবেশ করতে পারে।
- অজানা ইমেইল ও এটাচমেন্ট খোলা এড়িয়ে চলুন, কারণ অনেক ভাইরাস এইসব attachment এর মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
- কম্পিউটারের স্টার্টআপ আইটেম নিয়ন্ত্রণ করুন, যাতে অজানা প্রোগ্রাম স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে সিস্টেমের কার্যকারিতা ব্যাহত করতে না পারে।
- গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের নিয়মিত ব্যাকআপ রাখুন, যাতে কোনো ভাইরাস আক্রমণের ক্ষেত্রে ডেটা সহজেই পুনরুদ্ধার করা যায়।
এন্টিভাইরাস সফটওয়্যার কেন ব্যবহার করা প্রয়োজন?

এন্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি আমাদের কম্পিউটারকে ভাইরাস, ম্যালওয়্যার, ট্রোজান ও র্যানসমওয়্যারসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রোগ্রাম থেকে সুরক্ষা দেয়। এটি শুধুমাত্র ডিভাইসকে নিরাপদ রাখে না, বরং আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য বা অন্যান্য সংবেদনশীল তথ্য চুরি হওয়া থেকেও রক্ষা করে।
এছাড়াও, ইমেইল, ওয়েবসাইট বা অনলাইনের ডাউনলোডের মাধ্যমে ক্ষতিকর সফটওয়্যার প্রবেশের ঝুঁকি কমায় এবং সিস্টেমের কর্মক্ষমতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। অনেক এন্টিভাইরাস রিয়েলটাইম সুরক্ষা প্রদান করে। তাই নিরাপদভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার এবং ডিভাইসের দীর্ঘস্থায়ী কার্যক্ষমতা নিশ্চিত করতে এন্টিভাইরাস সফটওয়্যার ব্যবহার করা প্রয়োজন।
শেষ কথা
যদি কোনো কম্পিউটার ভাইরাস একটি কম্পিউটারে প্রবেশ করে, তবে এটি একই নেটওয়ার্কের অন্যান্য কম্পিউটারকেও সংক্রমিত করতে সক্ষম। ভাইরাসের ক্ষতিকারক কার্যকলাপের মধ্যে রয়েছে ব্যবহারকারীর পাসওয়ার্ড বা ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করা, ফাইল নষ্ট করা, ব্যবহারকারীর ইমেইল ঠিকানা ব্যবহার করে স্প্যাম পাঠানো এবং এমনকি পুরো কম্পিউটারের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া।
এই ধরনের কার্যকলাপ শুধু ব্যবহারকারীর তথ্য চুরি করে বা ক্ষতি করে না, বরং কম্পিউটারকে অচলও করে দিতে পারে। তাই সময় থাকতেই ভাইরাস থেকে বাঁচার উপায় জেনে নিন এবং নিরাপদ রাখুন আপনার কম্পিউটার।
