ledger is the king of all books

খতিয়ানকে সকল বইয়ের রাজা বলা হয় কেন? গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

আপনি কি জানেন খতিয়ানকে সকল বইয়ের রাজা বলা হয় কেন? কারবারের সকল লেনদেন সর্বপ্রথম জাবেদায় নথিভুক্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে সেগুলো খতিয়ানে স্থানান্তরিত হয়। তবে শুধুমাত্র জাবেদার মাধ্যমে ব্যবসার সম্পূর্ণ তথ্য বা আর্থিক অবস্থার চিত্র স্পষ্টভাবে জানা যায় না। ব্যবসার প্রকৃত ফলাফল ও আর্থিক অবস্থার সঠিক ধারণা একমাত্র খতিয়ান থেকেই পাওয়া সম্ভব। 

তবে এটাই খতিয়ান সম্পর্কে শেষ কথা নয়, আরও অনেক কথাই রয়েছে। কেন খতিয়ান এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা আমরা জানবো আজকের আর্টিকেল এর মাধ্যমে। কমার্সের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিনিয়তই খতিয়ান করে থাকেন, কিন্তু কেন করা হয় এই খতিয়ান, বা এর গুরুত্বই কতটুকু – তা আপনারা আজকে জানবেন। তাহলে চলুন আর সময় নষ্ট না করে জেনে নেয়া যাক। 

আরও পড়ুনঃ হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট কাকে বলে?

খতিয়ান কী?

ইংরেজি শব্দ ‘লেজ’ (Ledge) এর অর্থ হলো ‘তাক’ বা ‘shelf’। অনেকে ধারণা করেন, এই ‘লেজ’ (Ledge) শব্দ থেকেই ‘লেজার’ (Ledger) বা বাংলায় ‘খতিয়ান’ শব্দের উদ্ভব হয়েছে।

লেনদেন সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথেই সেগুলোকে কোনো প্রাথমিক বাছ-বিচার ছাড়াই তারিখক্রম অনুযায়ী জাবেদায় লিপিবদ্ধ করা হয়। তবে শুধুমাত্র জাবেদা থেকে লেনদেনের সঠিক ফলাফল নিরূপণ করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ, কোন খাতে কত আয় হয়েছে, কোন খাতে কত ব্যয় হয়েছে, ব্যবসার মোট পাওনা ও দেনা কত, অথবা কত টাকার সম্পত্তি ক্রয় করা হয়েছে; এসব তথ্য জাবেদা থেকে সরাসরি জানা যায় না।

যেখানে জাবেদায় শুধুমাত্র লেনদেনের প্রাথমিক নথি থাকে, খতিয়ান সেই তথ্যগুলোকে সমষ্টিগত ও বিশ্লেষণাত্মকভাবে উপস্থাপন করে। তাই ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত নেওয়া, পরবর্তী পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং আর্থিক পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য খতিয়ান অপরিহার্য। এটি হিসাবরক্ষক, ব্যবসায়ী এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য পক্ষের জন্য বিশ্বাসযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়।

খতিয়ানকে সকল বইয়ের রাজা বলা হয় কেন?

আপনারা যারা জাবেদা ও খতিয়ান করেছেন তাঁরা জানেন যে, হিসাবের প্রাথমিক নথি জাবেদাতে ব্যবসায়ের সকল লেনদেন তারিখক্রম অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করা হয়। তবে শুধুমাত্র জাবেদা থেকে লেনদেনের সামগ্রিক ফলাফল বা ব্যবসার মোট আর্থিক অবস্থা নির্ণয় সম্ভব নয়। এজন্য জাবেদার তথ্যগুলো খতিয়ানে স্থানান্তর করা হয়। 

খতিয়ানে স্থানান্তরের সময় প্রতিটি লেনদেনকে তাদের প্রকৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন শিরোনামে ভাগ করা হয়, সংক্ষিপ্ত ও শ্রেণীবদ্ধভাবে লিপিবদ্ধ করা হয় এবং তা স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা হয়। এর ফলে নির্দিষ্ট সময় পর ব্যবসার আয়, ব্যয়, লাভ-ক্ষতি ও আর্থিক অবস্থা সহজে নির্ণয় করা যায়। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, একবার লেনদেনগুলো খতিয়ানে স্থানান্তর করা হলে, জাবেদা আর সরাসরি ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না।

অতএব, এটি নিঃসন্দেহে সত্যি যে, ব্যবসায়ের ফলাফল নিরূপণের ক্ষেত্রে জাবেদা বইয়ের তুলনায় খতিয়ান বইয়ের গুরুত্ব অনেক বেশি। এজন্য একে বলা হয় হিসাবের পাকা বই। বিশ্লেষক Wilham Pickles-এর মতে, খতিয়ান হলো সমস্ত সহায়ক হিসাবপত্র বা ‘সাহায্যকারী বই’ এর যাবতীয় দাখিলার চূড়ান্ত গন্তব্যস্থল। 

অর্থাৎ, যে কোনো লেনদেন বা হিসাবের চূড়ান্ত তথ্য খতিয়ানে সংরক্ষিত হয়। এই কারণে খতিয়ানকে কখনো কেউ ‘সমস্ত বইয়ের রাজা’ (King of all books) হিসেবেও অভিহিত করেছেন। জাবেদা ব্যবসার প্রাথমিক নথি হলেও, ব্যবসার সঠিক আর্থিক মূল্যায়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য খতিয়ানই মূল।

খতিয়ানের প্রধান বৈশিষ্ট্য কী কী?

নিম্নে খতিয়ানের প্রধান বৈশিষ্ট্য গুলো সংক্ষেপে উল্লেখ করছিঃ 

  • প্রতিটি লেনদেনকে সংক্ষিপ্তভাবে এবং প্রাকৃতিক শ্রেণিবিন্যাস অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করা হয়।
  • খতিয়ানের মাধ্যমে দু’ তরফা দাখিলা পদ্ধতি অনুযায়ী ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের পূর্ণাঙ্গ হিসাব রক্ষা করা যায়। 
  • প্রতিটি হিসাবের প্রকৃত অবস্থা নির্ধারণের জন্য খতিয়ান অবশ্যই প্রয়োজন।
  • খতিয়ানে লিপিবদ্ধ ব্যক্তিবাচক হিসাবসমূহ থেকে ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের দেনা ও পাওনার পরিমাণ জানা যায়।
  • খতিয়ান হিসাবসমূহের উদ্‌বৃত্ত তৈরি করে হিসাবের গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাই করা যায়।
  • নির্দিষ্ট কোনো তারিখে উদ্‌বৃত্ত পত্র প্রস্তুত করে ব্যবসায়ের আর্থিক অবস্থা নির্ণয় করা সম্ভব।
  • খতিয়ানে লিপিবদ্ধ হিসাবসমূহকে পূর্ববর্তী বছরের হিসাবের সঙ্গে তুলনা করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়।
  • হিসাব সংক্রান্ত সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য কেবলমাত্র খতিয়ান থেকেই পাওয়া সম্ভব।

খতিয়ানের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তাঃ

importance of ledger

আধুনিক হিসাব পদ্ধতিতে খতিয়ানের প্রয়োজন অপরিসীম। কারণ খতিয়ানে হিসাবরক্ষণ ছাড়া হিসাবের মূল উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের লেনদেনসমূহ তারিখের ক্রমানুসারে প্রাথমিক হিসাবের বই জাবেদায় লিপিবদ্ধ করা হয়। কিন্তু এটি থেকে লেনদেনের সামগ্রিক ফলাফল জানা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে, সংক্ষিপ্ত আকারে এবং শ্রেণীবদ্ধভাবে সাজিয়ে বিভিন্ন হিসাব খতিয়ানে স্থানান্তর করলে আর্থিক ফলাফল ও অন্যান্য তথ্য সহজেই জানা যেতে পারে। অতএব হিসাব রক্ষণের ক্ষেত্রে খতিয়ানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। 

খতিয়ান ব্যবহার না করলে ব্যবসায়ের হিসাবরক্ষণে কী অসুবিধা দেখা দিতে পারে?

খতিয়ান ব্যবহার না করলে ব্যবসায়ের হিসাবরক্ষণে অসংখ্য অসুবিধা দেখা দিতে পারে। কারণ খতিয়ান ছাড়া হিসাবরক্ষণের উদ্দেশ্যই অপূর্ণ থেকে যায়। খতিয়ান ব্যবহার না করলে যে প্রধান সমস্যাগুলো হয় সেগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলোঃ 

  1. খতিয়ান ছাড়া কোনো নির্দিষ্ট হিসাবের মোট ডেবিট ও ক্রেডিট পরিমাণ জানা অসম্ভব। ফলে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে আপনার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় না।
  2. প্রতিষ্ঠানের লাভ বা ক্ষতি বের করার জন্য মোট আয় থেকে মোট ব্যয় বাদ দিতে হয়। কিন্তু খতিয়ান ছাড়া সব আয় ও ব্যয়ের হিসাব আলাদাভাবে জানা সম্ভব নয়। 
  3. জাবেদায় সব লেনদেন তারিখ অনুযায়ী লিপিবদ্ধ থাকায় সেখানে কোনো গাণিতিক ভুল হলে তা খুঁজে বের করা কঠিন। খতিয়ান ব্যবহার করে রেওয়ামিল প্রস্তুত করা হয়, যা হিসাবের গাণিতিক শুদ্ধতা যাচাই করতে সাহায্য করে। 
  4. খতিয়ান ছাড়া একজন ব্যবস্থাপকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
  5. খতিয়ান না থাকলে হিসাব নিরীক্ষকরা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক তথ্য যাচাই করতে পারেন না এবং হিসাবের স্বচ্ছতা সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি হয়।

FAQs

খতিয়ান কেন ব্যবসায়ের হিসাবরক্ষায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই হিসেবে বিবেচিত হয়?

খতিয়ান ব্যবসায়ের হিসাবরক্ষণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই হিসেবে বিবেচিত হয়, কারণ এটি লেনদেনগুলোকে সুশৃঙ্খল ও শ্রেণিবদ্ধভাবে সাজিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র প্রদান করে। যদি জাবেদা হিসাবরক্ষণের প্রথম ধাপ হয়, তবে খতিয়ান হলো এমন একটি ধাপ যেখানে হিসাবগুলো চূড়ান্ত রূপ নেয় এবং সেখান থেকেই যেকোনো হিসাবের বর্তমান অবস্থা সহজে জানা যায়। খতিয়ানে প্রতিটি হিসাবের জন্য আলাদা আলাদা পাতা বা অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এতে করে একটি নির্দিষ্ট সময়ে যেকোনো হিসাবের মোট ডেবিট ও ক্রেডিট পরিমাণ এবং তার জের বা ব্যালেন্স সহজেই জানা যায়।

খতিয়ান ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কীভাবে সহায়তা করে? 

খতিয়ান থেকে প্রতিটি হিসাবের বর্তমান জের জানা যায়। এর ফলে, ব্যবস্থাপকরা তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারেন যে প্রতিষ্ঠানের হাতে কত নগদ টাকা আছে, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের অবস্থা কী, এবং কত টাকা পাওনা বা দেনা রয়েছে। এই তথ্যগুলো প্রতিষ্ঠানের সার্বিক আর্থিক স্বাস্থ্য বুঝতে সাহায্য করে। এটি কেবল লেনদেন রেকর্ড করে না, বরং সেই তথ্যগুলোকে এমনভাবে শ্রেণিবদ্ধ করে, যা একটি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা পরিষ্কারভাবে বুঝতে সাহায্য করে।

খতিয়ানে লিপিবদ্ধ তথ্যের মাধ্যমে কোন কোন আর্থিক বিষয় নির্ণয় করা যায়?

খতিয়ানে বিক্রয় এবং ক্রয় হিসাব থেকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মোট বিক্রয় ও ক্রয়ের পরিমাণ জানা যায়। এখানে প্রতিটি দেনাদার এবং পাওনাদার এর আলাদা হিসাব থাকে। এর মাধ্যমে জানা যায় কোন গ্রাহকের কাছে কত টাকা পাওনা আছে এবং কোন সরবরাহকারীকে কত টাকা দিতে হবে। এটি সঠিক সময়ে দেনা পাওনা পরিশোধে সাহায্য করে। 

শেষ কথা

আশা করছি, খতিয়ানকে সকল বইয়ের রাজা বলা হয় কেন – এই প্রশ্নটির একটি বিস্তারিত উত্তর দিতে আমরা সক্ষম হয়েছি। খতিয়ান ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লেনদেনের হিসাব কখনও সম্পন্ন হয়না। প্রাথমিকভাবে জাবেদায় লিপিবদ্ধ করা লেনদেনগুলোকে খতিয়ানে শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী পৃথক শিরোনামে স্থানান্তর করা হয়। 

এর ফলে খতিয়ান বিভিন্ন হিসাবখাতের সমজাতীয় লেনদেনের স্থায়ী রেকর্ডের একমাত্র মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই কোনো ব্যবসার আর্থিক অবস্থার সম্পূর্ণ তথ্য ও বিশ্লেষণ শুধুমাত্র খতিয়ানের মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব। 

Author

  • শারমিন সিমি একজন প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষিকা, যিনি বর্তমানে ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা করছেন। তিনি অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন নিজ বিভাগে কৃতিত্বের সঙ্গে। শিক্ষাদানে তাঁর গভীর ভালোবাসা ও নিষ্ঠা তাঁকে শিক্ষার্থীদের প্রিয় করে তুলেছে।

    শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তিনি ওয়েবসাইটে নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ক তথ্য, পরামর্শ এবং অনুপ্রেরণামূলক লেখা প্রকাশ করেন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *