Grameen Bank Project

গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প কত সালে চালু হয়? উদ্দেশ্য ও প্রভাব

গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক উন্নয়নমূলক উদ্যোগ, যা দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অসাধারণ অবদান রেখেছে। বাংলাদেশের মতো কৃষিনির্ভর ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দেশে দারিদ্র্য বিমোচন সবসময়ই বড় একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। এই প্রেক্ষাপটে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ১৯৭৬ সালে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি শুরু করেন, যা পরবর্তীতে গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প নামে সুপরিচিত হয়। এই প্রকল্প শুধু অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা নয়, নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও গ্রামীণ সমাজের পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

গ্রামীণ ব্যাংকের মূল লক্ষ্য হলো দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি সাধন। এ ব্যাংক সমাজের দরিদ্র ও অসহায় শ্রেণির জন্য জামানতবিহীন ঋণ চালু করেছে, যা আজ শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। এখানে মূলত ভূমিহীন ও দরিদ্র জনগণই ঋণ গ্রহণের সুযোগ পেয়ে থাকেন।

আরও পড়ুনঃ তথ্য অধিকার আইন কি?

গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প কত সালে চালু হয়? 

গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের সূচনা হয় ১৯৭৬ সালে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস উপলব্ধি করেন যে, গ্রামের গরিব মানুষরা ক্ষুদ্র মূলধনের অভাবে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রে আবদ্ধ। তারা টাকা ধার করতে বাধ্য হয় মহাজন বা সুদখোরদের কাছ থেকে, যা তাদের আরও নিঃস্ব করে তোলে।

এই প্রেক্ষাপটে তিনি জোবরা গ্রামে কয়েকজন দরিদ্র মানুষকে জামানতবিহীন ঋণ দেন। পরীক্ষামূলক এ উদ্যোগ সফল প্রমাণিত হলে ধীরে ধীরে তা একটি বৃহৎ আকার ধারণ করে এবং ১৯৮৩ সালে সরকারিভাবে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো দরিদ্র মানুষকে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করা।

গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্যঃ 

Grameen Bank Project purpose

গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য হলো সমাজের দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলা। বিশেষ করে যেসব মানুষ সাধারণ ব্যাংকিং সেবা থেকে বঞ্চিত হন, তাদেরকে জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণ দেওয়ার মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল করে তোলাই এ প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য। নিচে এর উদ্দেশ্যগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো:

  • দারিদ্র্য দূরীকরণ ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন

গ্রামীণ ব্যাংক মূলত ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দরিদ্র মানুষদের ছোট ব্যবসা, কৃষিকাজ কিংবা স্বনির্ভর উদ্যোগ শুরু করতে সহায়তা করে। এতে করে তারা সংসার চালানোর পাশাপাশি অতিরিক্ত আয় করতে পারে এবং দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হতে পারে।

  • নারীর ক্ষমতায়ন

এই ব্যাংক প্রকল্পের ঋণগ্রহীতাদের একটি বড় অংশ হলো নারী। নারীদেরকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন করা, সংসার পরিচালনায় তাদের ভূমিকা বাড়ানো এবং সমাজে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করাই অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। ফলে নারীরা শুধু পরিবারের দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবেই নয়, বরং একজন উদ্যোক্তা হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন।

  • কর্মসংস্থান সৃষ্টি

ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণ করে অনেকে ছোট ব্যবসা, গরু ছাগল পালন, হাঁস-মুরগি চাষ, সেলাই-কাটিং কিংবা দোকানদারি শুরু করেন। এতে নিজে যেমন উপার্জন করতে পারেন, তেমনি অন্যদেরও কাজে লাগাতে পারেন। ফলে বেকারত্ব কমে আসে।

  • গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা

গ্রামের মানুষ স্বাবলম্বী হলে সামগ্রিক গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা হয়। কৃষি, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও শিল্প কার্যক্রমে বিনিয়োগ বাড়ে। গ্রামের মানুষ শহরমুখী না হয়ে নিজেদের এলাকায় অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে।

  • সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে তোলা

ঋণ দেওয়ার পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাংক সঞ্চয় করার দিকেও মানুষকে উৎসাহিত করে। প্রতিটি ঋণগ্রহীতা নির্দিষ্ট সময় পর পর অল্প অল্প করে টাকা জমা দেন। এতে করে তাদের মধ্যে সঞ্চয়ের অভ্যাস তৈরি হয়, যা ভবিষ্যতে আর্থিক নিরাপত্তা দেয়।

গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য সমূহঃ 

গ্রামীণ ব্যাংক প্রচলিত ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে এক ভিন্নধর্মী কার্যপ্রণালী অনুসরণ করে। এর কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা এর কার্যক্রমকে অন্যদের থেকে ভিন্ন করেছেঃ 

  • দরিদ্র মানুষদের কাছ থেকে কোনো প্রকার জামানত নেওয়া হয় না।
  • সাধারণত পাঁচজনের একটি দল গঠন করে ঋণ দেওয়া হয়, যাতে পারস্পরিক আস্থা ও দায়বদ্ধতা তৈরি হয়।
  • ক্ষুদ্র কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করতে হয়, যাতে ঋণগ্রহীতারা চাপমুক্ত থাকে।
  • ব্যাংকের সদস্যরা ক্ষুদ্র অংকের সঞ্চয় জমা রাখতে পারে।
  • ঋণগ্রহীতাদের প্রায় ৯০ শতাংশই নারী।

গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের প্রভাব কী কী? 

গ্রামীণ ব্যাংক দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে স্বনির্ভর হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। আগে যারা দারিদ্র্যের কারণে ভিক্ষাবৃত্তি বা দিনমজুরির কাজ করত, তারা এখন ছোটখাটো ব্যবসা, কৃষিকাজ, পশুপালন কিংবা হস্তশিল্পের মাধ্যমে আয় করছে। ফলে গ্রামীণ অঞ্চলে দারিদ্র্য কমছে এবং মানুষের জীবনমান উন্নত হচ্ছে।

বিশেষ করে নারীদের ক্ষমতায়নে গ্রামীণ ব্যাংকের অবদান উল্লেখযোগ্য। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, যার ফলে তারা সংসারের খরচ বহন, সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন ব্যবসায়িক কাজে এগিয়ে আসছে। এর মাধ্যমে পরিবার ও সমাজে নারীদের মর্যাদা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

গ্রামীণ ব্যাংক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেও বড় ভূমিকা রাখছে। ক্ষুদ্রঋণের টাকায় অনেকে নতুন ব্যবসা শুরু করে নিজের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে এবং একই সঙ্গে অন্যদেরও কাজের সুযোগ করে দিয়েছে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে এবং শহরমুখী অভিবাসন কিছুটা হলেও হ্রাস পাচ্ছে।

এছাড়াও গ্রামীণ ব্যাংক শিক্ষার প্রসারে অবদান রেখেছে। আয় বাড়ার কারণে অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারছে, বিশেষ করে মেয়েশিশুদের শিক্ষায় ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। একই সঙ্গে ব্যাংকের নীতির কারণে ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে সঞ্চয়ের অভ্যাস গড়ে উঠেছে, যা ভবিষ্যতের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।

গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ গ্রহণে কী কী নিয়ম কানুন রয়েছে?

গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ গ্রহণে কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন রয়েছে, যা ঋণ সঠিকভাবে ব্যবহারের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণঃ 

  • গ্রামীণ ব্যাংক জামানত ছাড়া ঋণ প্রদান করে, তবে ঋণগ্রহীতাকে একটি ঋণগ্রহীতা দলের সদস্য হতে হয়। সাধারণত পাঁচজন নারী বা পুরুষ মিলে একটি দল গঠন করা হয়।
  • ঋণ দেওয়ার আগে ব্যাংকের কর্মকর্তারা ঋণগ্রহীতার আর্থিক অবস্থা ও ব্যবসার সম্ভাবনা যাচাই করেন। অর্থাৎ, ঋণ কী কাজে লাগানো হবে, তার একটি স্পষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হবে।
  • ঋণের টাকা অবশ্যই আয়বর্ধক কাজে ব্যবহার করতে হবে। ব্যক্তিগত ভোগ বা অপচয়ে ব্যয় করলে পরবর্তী ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে যায়।
  • ঋণগ্রহীতাকে সাপ্তাহিক কিস্তির মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে হয়। কিস্তি প্রদানে অনিয়ম হলে দল এবং ব্যাংক উভয়ের পক্ষ থেকেই চাপ থাকে।
  • প্রতিটি ঋণগ্রহীতা দল নিয়মিত সাপ্তাহিক বৈঠকে অংশ নেয়। সেখানে সঞ্চয় জমা দেওয়া, ঋণের ব্যবহার ও পরিশোধের অগ্রগতি আলোচনা করা হয়।
  • ঋণ গ্রহণের শর্ত হিসেবে সঞ্চয় করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হয়। প্রতি সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক সঞ্চয় হিসেবে জমা রাখতে হয়।
  • নারীদের ক্ষমতায়ন বাড়াতে গ্রামীণ ব্যাংক বিশেষভাবে নারীদের অগ্রাধিকার দেয়। তাই ঋণগ্রহীতাদের মধ্যে অধিকাংশই নারী।

FAQs

গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প নারীদের জীবনে কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে?

গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প নারীদের জীবনে ব্যাপক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে নারীরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পেরেছে। নারীদের ক্ষমতায়ন ও সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে নারীর আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মান বৃদ্ধি পেয়েছে।

গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নাকি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে?

গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি আজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক মডেল প্রথমে বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের জন্য ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা চালু করলেও এর সাফল্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ মডেল অনুসরণ করেছে। 

গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ কত টাকা লোন নেওয়া যায়?

গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ নির্ভর করে আবেদনকারীর আর্থিক চাহিদা এবং তার পেশার ওপর। সাধারণভাবে, ক্ষুদ্রঋণের পরিমাণ ৫,০০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। তবে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে বা ব্যবসায়িক উদ্যোগের জন্য এই সীমার চেয়ে বেশি ঋণও প্রদান করা হতে পারে।

শেষ কথা

গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য একটি যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত। দরিদ্র মানুষকে স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি এই প্রকল্প গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। যদিও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তারপরও এর সাফল্যই বেশি। বিশ্বব্যাপী গ্রামীণ ব্যাংক মডেল অনুসরণ করা হচ্ছে, যা প্রমাণ করে বাংলাদেশের এই প্রকল্প কেবল দেশ নয়, বিশ্বের দরিদ্র মানুষের জন্যও আশার আলো।

Author

  • শারমিন সিমি একজন প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষিকা, যিনি বর্তমানে ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা করছেন। তিনি অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন নিজ বিভাগে কৃতিত্বের সঙ্গে। শিক্ষাদানে তাঁর গভীর ভালোবাসা ও নিষ্ঠা তাঁকে শিক্ষার্থীদের প্রিয় করে তুলেছে।

    শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তিনি ওয়েবসাইটে নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ক তথ্য, পরামর্শ এবং অনুপ্রেরণামূলক লেখা প্রকাশ করেন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *