বক্সারের যুদ্ধ কত সালে হয়? কারণ ও ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত
ইতিহাসের পাতায় কিছু যুদ্ধ কেবল সামরিক সংঘাত হিসেবে চিহ্নিত হয় না, বরং তা একটি জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে এমন একটি সংঘাত হলো বক্সারের যুদ্ধ, যা ১৭৬৪ সালের ২২ অক্টোবর বর্তমান বিহারের বক্সার নামক স্থানে সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে ভারতীয় জোটের শোচনীয় পরাজয় সুদূরপ্রসারী ফল বয়ে এনেছিল, যা বাংলায় এবং পরবর্তীতে সমগ্র ভারতে ইংরেজদের একচ্ছত্র আধিপত্যের পথ খুলে দেয়। এই আর্টিকেল টিতে আমরা বক্সারের যুদ্ধ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
আরও পড়ুনঃ ইসলামের প্রথম যুদ্ধের নাম কি?
বক্সারের যুদ্ধ কী?
পলাশীর যুদ্ধের পর মীরজাফর বাংলার নবাবের পদে অধিষ্ঠিত হলেও ইংরেজদের প্রভাব ও চাপের কারণে তিনি প্রকৃত ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেননি এবং কার্যত পুতুল নবাবে পরিণত হন। ইংরেজদের অতিরিক্ত অর্থ দাবি ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে তিনি ক্রমেই অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েন। ১৭৬০ সালে মীর কাসিম নবাব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করলে তিনি স্বাধীনভাবে শাসন চালানোর উদ্যোগ নেন। তবে এতে ইংরেজদের বাণিজ্যিক স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় উভয়ের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়, যা পরবর্তীতে বক্সারের যুদ্ধে গিয়ে পরিণত হয়।
বক্সারের যুদ্ধের কারণ কী?
ইংরেজদের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা এবং রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা মীর কাসিমের স্বাধীন ও দৃঢ় মনোভাবের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এই দ্বন্দ্বই পরবর্তীতে বক্সারের যুদ্ধের প্রধান কারণ হিসেবে দেখা দেয়। মীর কাসিম ইংরেজদের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে স্বশাসিতভাবে রাজ্য পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন এবং সেই লক্ষ্যেই তিনি প্রশাসনিক ও আর্থিক ব্যবস্থায় নানা সংস্কার উদ্যোগ নেন, যা ইংরেজদের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা ‘দস্তক’ সুবিধা ব্যবহার করে শুল্ক না দিয়ে বাণিজ্য চালিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ক্ষতিগ্রস্ত করছিল। এই বৈষম্য দূর করতে মীর কাসিম সব বণিকের জন্য শুল্ক তুলে দেন, যাতে সমান সুযোগে ব্যবসা করা যায়। কিন্তু এতে ইংরেজদের একচেটিয়া বাণিজ্যিক সুবিধা নষ্ট হয়ে যায় এবং তারা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
এছাড়া মীর কাসিম রাজ্যের জমিদার, রাজা ও ব্যবসায়ীদের ওপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার চেষ্টা করেন। যেসব প্রভাবশালী ব্যক্তি ইংরেজদের সহযোগিতা করছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর পদক্ষেপ নেন। এর ফলে ইংরেজদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আরও অবনতির দিকে যায়।
এদিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ বাড়িয়ে দেয় এবং নবাবকে কেবল নামমাত্র শাসকে পরিণত করতে চায়। মীর কাসিম এই শর্ত মেনে নিতে অস্বীকার করেন। অবশেষে ১৭৬৩ সালে ধারাবাহিক কয়েকটি সংঘর্ষের পর তিনি অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা ও মুঘল সম্রাট শাহ আলম দ্বিতীয়ের সঙ্গে জোট বাঁধেন। এই জোট গঠনের মধ্য দিয়েই বক্সারের যুদ্ধের সূচনা হয়।
যুদ্ধ কীভাবে সংঘটিত হয়?
১৭৬৪ সালের ২২-২৩ অক্টোবর, হেক্টর মনরোর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সেনারা প্রায় ১৭,০০০ জন সৈন্য নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। অন্যদিকে, মীর কাসিম, সুজাউদ্দৌলা এবং সম্রাট শাহ আলমের সম্মিলিত বাহিনী প্রায় ৪০,০০০ জনের বেশি ছিল। তবুও, সমন্বয়ের অভাব, বিশ্বাসঘাতকতা এবং দুর্বল রণকৌশলের কারণে জোটবাহিনী পরাজিত হয়। যুদ্ধে হারের পর মীর কাসিম পালিয়ে যান এবং পরবর্তীতে দীর্ঘ সময়ের পর ১৭৭৭ সালে অজ্ঞাত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
বক্সারের যুদ্ধের ফলাফল কী হয়েছিলো?

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই যুদ্ধে জয়লাভ করে এবং পুরো ভারতবর্ষে তাদের শাসনের ভিত্তি শক্তিশালী করে। এই বিজয়ের ফলে বাংলার রাজনৈতিক স্বাধীনতার শেষ অবশিষ্ট চিহ্নও মুছে যায়। ইংরেজরা মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে দেওয়ানি অধিকার লাভ করে, অর্থাৎ রাজস্ব সংগ্রহের পূর্ণ ক্ষমতা তাদের হাতে চলে আসে। এতে ব্রিটিশ শাসনের প্রশাসনিক ভিত্তি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
সুজাউদ্দৌলা অযোধ্যায় পরাজিত হন, এবং সম্রাট শাহ আলম দ্বিতীয়কে বাধ্য করা হয় ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তি করতে। চুক্তি অনুযায়ী সম্রাট বাংলার রাজস্ব আদায়ের অধিকার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে স্বীকার করেন, যা ব্রিটিশ শাসনের আর্থিক ও রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করে।
FAQs
বক্সারের যুদ্ধের সময় বাংলার গভর্নর কে ছিলেন ?
বক্সারের যুদ্ধ যখন ১৭৬৪ সালের ২২ অক্টোবর সংঘটিত হয়, তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে হেনরি ভ্যান্সিটার্ট বাংলার গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। ভ্যান্সিটার্ট ১৭৬০ সালে বাংলার গভর্নর পদে আসেন। ভ্যান্সিটার্টের শাসনকাল মূলত মীর জাফরের পরিবর্তে মীর কাসিমকে বাংলার নবাব হিসেবে সিংহাসনে বসানো এবং পরবর্তী সময়ে তার সঙ্গে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্কের অবনতি দ্বারা বোঝানো হয়।
বক্সারের যুদ্ধের সময় মুঘল সম্রাট কে ছিলেন ?
বক্সারের যুদ্ধের সময় মুঘল সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় শাহ আলম। দ্বিতীয় শাহ আলম ছিলেন এই যুদ্ধে গঠিত ভারতীয় সম্মিলিত জোটের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তিনি বাংলার পদচ্যুত নবাব মীর কাসিম এবং অযোধ্যার নবাব সুজা-উদ-দৌলার সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন।
বক্সারের যুদ্ধে জোটবাহিনীর মধ্যে কোন কারণে পরাজয় ঘটে?
বক্সারের যুদ্ধে জোটবাহিনীর পরাজয়ের মূল কারণগুলোর মধ্যে একটি ছিল নেতৃত্বের অভাব। জোটবাহিনীর মধ্যে একাধিক স্বাধীন নেতা থাকায় সিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি হয়। পর্যাপ্ত খাদ্য ও সরঞ্জামের অভাবে সৈন্যদের মনোবলও কমে যায়। জোটের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সহযোগিতা ও ঐক্য কম থাকার কারণে লড়াইয়ে সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। এই সমস্ত কারণে জোটবাহিনী যথাযথভাবে প্রতিরোধ গঠন করতে ব্যর্থ হয় এবং শেষ পর্যন্ত বক্সারের যুদ্ধে পরাজিত হয়।
শেষ কথা
বক্সারের যুদ্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় হিসেবে বিবেচিত হয়। এই যুদ্ধে মীর কাসিম, সুজাউদ্দৌলা এবং সম্রাট শাহ আলম দ্বিতীয়ের পরাজয়ের ফলে ব্রিটিশ শাসনের ভিত্তি দৃঢ় হয়। বাংলা তার সার্বভৌমত্ব হারায় এবং ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাস্তবে ভারতের ক্ষমতাধর শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং, বক্সারের যুদ্ধকে বলা যায় ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রকৃত সূচনা।
