Right to Information Act

তথ্য অধিকার আইন কি? এর উদ্দেশ্য ও প্রয়োগ সম্পর্কে লিখুন

তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও যুগান্তকারী উদ্যোগ। এ আইন জনগণের ক্ষমতায়নের পথে এক বিশাল অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হয়। দেশের অন্যান্য আইন যেখানে সাধারণত কর্তৃপক্ষ জনগণের ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করে, সেখানে এই আইনের বিশেষত্ব হলো, এখানে জনগণই কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জবাবদিহি দাবি করতে পারে। এটি একটি প্রকৃত নাগরিকবান্ধব আইন, যা গণতান্ত্রিক চেতনার প্রতিফলন ঘটায়। 

শ্রেণি, পেশা বা সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিককে রাষ্ট্রের তথ্য জানার অধিকার প্রদান করা হয়েছে। ফলে আইনটি সর্বজনীন রূপ লাভ করেছে এবং জনগণের সত্যিকারের আইন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যেহেতু আপনি একজন বাংলাদেশের নাগরিক, কাজেই তথ্য অধিকার আইন কি এবং এর প্রয়োগসহ অন্যান্য বিষয় জেনে রাখা আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আজকের এই লেখাটিতে আমরা তথ্য আইন সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরতে চেষ্টা করবো।

আরও পড়ুনঃ সেভেন সিস্টার কি? সেভেন সিস্টার্স মনে রাখার কৌশল

তথ্য অধিকার আইন কি?

তথ্যের অবাধ প্রবাহ এবং জনগণের তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে যে আইন প্রণীত হয়েছে, তাকে তথ্য অধিকার আইন বলা হয়। বাংলাদেশে ২০০৯ সালে গৃহীত তথ্য অধিকার আইন নাগরিকদের সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার বৈধ অধিকার প্রদান করে। এই আইনের মাধ্যমে যেকোনো নাগরিক সরকারি প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রণালয়, বিভাগ, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থা থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। 

ফলে জনগণ সরাসরি রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হতে পারে। তথ্য অধিকার আইন ২০০৯-এর মূল লক্ষ্য হলো সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম, নীতি, সিদ্ধান্ত ও প্রক্রিয়ার ব্যাপারে জনগণকে অবহিত করা এবং সঠিক তথ্য প্রদানের মাধ্যমে সরকারের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা।

তথ্য অধিকার আইনে কী কী রয়েছে? 

তথ্য অধিকার আইন ২০০৯-এর প্রস্তাবনায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বর্ণিত রয়েছে যেগুলো এই আইনের মূল দর্শন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা, ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণ এবং সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার সুরক্ষায় তথ্য অধিকার আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। রাষ্ট্রের সব উন্নয়ন কর্মসূচি, সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর তথ্য জনগণকে জানানো বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যাতে নাগরিকরা তাদের প্রাপ্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারেন। 

তথ্য অধিকারকে তাই বলা হয় ‘অধিকারগুলোর অধিকার’ (Right of all Rights), কারণ এটি সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদ বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত। এই আইন ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সকল নাগরিকের তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করে এবং প্রত্যেককে রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়। এর মাধ্যমে জনগণ উন্নয়নের মূল ধারায় যুক্ত হয় এবং ক্ষমতায়নের বাস্তব অনুভূতি লাভ করে। 

তথ্য অধিকার আইনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সরকারি কর্তৃপক্ষগুলোকে নিজ উদ্যোগে সর্বাধিক তথ্য জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। প্রতিটি সরকারি দপ্তর তাদের কার্যক্রম সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করবে, যাতে সাধারণ নাগরিক সহজেই সেসব তথ্য পেতে পারে। পাশাপাশি নাগরিকদের পক্ষ থেকে যদি অতিরিক্ত কোনো তথ্যের আবেদন আসে, তবে কর্তৃপক্ষকে আন্তরিকতার সঙ্গে তা সরবরাহ করতে হবে।

তথ্য অধিকার আইনের উদ্দেশ্যঃ 

তথ্য অধিকার আইনের প্রধান লক্ষ্য হলো নাগরিকদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা, সরকারি কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ করা। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেন জনগণের স্বার্থে কাজ করে, তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। নাগরিকরা প্রয়োজনে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্যের আবেদন করতে পারেন, যা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি করে। বিশেষ করে জনগণের অর্থে পরিচালিত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য হয়।

আইনের ১০ ধারায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক দপ্তরে তথ্য সরবরাহের জন্য একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা বাধ্যতামূলক। আবেদন করার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যদি তথ্য প্রদান না করা হয়, তবে আবেদনকারী আপিল করতে পারবেন। এর জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একজন আপিল কর্মকর্তা নির্ধারিত আছেন। আপিল কর্মকর্তার কাছ থেকেও যদি সমাধান না মেলে, তবে তথ্য কমিশনে অভিযোগ দায়ের করার সুযোগ রয়েছে।

তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগের কৌশলঃ

Enforcement of Information Act

তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ সবসময় সহজ হয় না। আবেদন করলেই যে প্রাপ্ত তথ্য আপনার কাজে আসবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। তবে ধৈর্য ধরে চেষ্টা চালিয়ে গেলে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া সম্ভব। এ কারণেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকরা এ আইনকে কাজে লাগিয়ে অসাধারণ সব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করছেন। অনেকে নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল তথ্য সংগ্রহের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। চাইলে আপনিও তাদের অভিজ্ঞতাকে পথনির্দেশক হিসেবে গ্রহণ করতে পারেন। এতে করে ধীরে ধীরে আপনার ভয় কেটে যাবে এবং তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় আত্মবিশ্বাসও বাড়বে।

অনেক মানুষ এখনো তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত নন, আবার কারও কারও ক্ষেত্রে আইনটি প্রয়োগে অনীহা ও সংবেদনশীলতার অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তথ্য কমিশনের শুনানিকালে এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। দেখা যায়, অনেক সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে প্রয়োজনীয় তথ্য সংরক্ষিত থাকা সত্ত্বেও এবং তা সরবরাহ করার আইনগত বাধ্যবাধকতা বুঝলেও কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতা বা অনীহার কারণে আবেদনকারীরা তথ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এক্ষেত্রে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা পরিলক্ষিত হয়। 

এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হলে আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য একদিকে সাধারণ মানুষকে তথ্য জানার বিষয়ে উৎসাহিত ও সচেতন করতে হবে, অন্যদিকে তথ্য সরবরাহকারী কর্মকর্তাদের দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে হবে, যাতে এই আইন বাস্তবে সবার জন্য কার্যকর হয়। এ কাজে দেশের সব শ্রেণী পেশার মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই তথ্য অধিকার আইন সত্যিকারের জনকল্যাণে পরিণত হবে এবং সমাজে এর প্রকৃত সুফল নিশ্চিত হবে।

FAQs

তথ্য অধিকার আইনকে কেন একটি নাগরিকবান্ধব আইন বলা হয়?

তথ্য অধিকার আইনকে নাগরিকবান্ধব বলা হয় কারণ এটি শ্রেণি, পেশা বা সামাজিক অবস্থার নির্বিশেষে সকল নাগরিককে সরকারের তথ্য জানার অধিকার প্রদান করে। আইনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য প্রাপ্তির সুযোগ পায়, যা তাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করে। এছাড়া আইনটি সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং জনগণের অংশগ্রহণকে বাড়িয়ে দেয়, ফলে নাগরিকরা সহজেই তাদের প্রাপ্য অধিকার আদায় করতে পারে। 

তথ্য অধিকার আইন স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় কীভাবে ভূমিকা রাখে?

আইনটি তথ্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা আরোপ করে, যা সরকারী কর্মকাণ্ডকে খোলামেলা এবং মনিটরযোগ্য করে তোলে। পাশাপাশি নাগরিকরা অনিয়ম বা দুর্নীতির তথ্য সংগ্রহ করতে পারে, যার ফলে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায় এবং দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত হয়। সংক্ষেপে, এই আইন নাগরিকদের ক্ষমতায়ন করে এবং সরকারি ও বেসরকারি কার্যক্রমকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতার আওতায় আনে।

তথ্য অধিকার আইন দুর্নীতি প্রতিরোধে কীভাবে সহায়তা করে?

তথ্য অধিকার আইন দুর্নীতি প্রতিরোধে সরাসরি সহায়তা করে। তথ্যের স্বচ্ছ প্রবাহ নিশ্চিত হওয়ায় অনিয়ম, লুকানো খরচ বা দুর্নীতির চেষ্টাগুলো প্রকাশ্যে আসে। সরকারি কর্মকর্তারা যখন জানেন যে তাদের কাজের তথ্য নাগরিকরা সহজে পেতে পারবে, তখন তারা আরও সতর্ক ও জবাবদিহিতার সঙ্গে কাজ করতে বাধ্য হন। ফলে আইনটি প্রশাসনিক স্বচ্ছতা বাড়ায়, দুর্নীতির সুযোগ কমায় এবং দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করে।

শেষ কথা 

তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ বাংলাদেশের প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠার এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই আইন নাগরিকদের তথ্য জানার অধিকার সুরক্ষিত করে এবং সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে আরও খোলামেলা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনে। এ আইন সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রয়োগ প্রক্রিয়া আরও কার্যকর করার মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব। সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে এই আইন দুর্নীতি দমন এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশকে সুশাসনের পথে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।

Author

  • শারমিন সিমি একজন প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষিকা, যিনি বর্তমানে ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা করছেন। তিনি অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন নিজ বিভাগে কৃতিত্বের সঙ্গে। শিক্ষাদানে তাঁর গভীর ভালোবাসা ও নিষ্ঠা তাঁকে শিক্ষার্থীদের প্রিয় করে তুলেছে।

    শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তিনি ওয়েবসাইটে নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ক তথ্য, পরামর্শ এবং অনুপ্রেরণামূলক লেখা প্রকাশ করেন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *