alaler ghorer dulal

আলালের ঘরের দুলাল কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়?

আলালের ঘরের দুলাল হলো বাংলা সাহিত্যের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী উপন্যাস। এটি বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রথমদিকের সার্থক ও জনপ্রিয় উপন্যাসগুলির মধ্যে অন্যতম। উপন্যাসটির মূল উদ্দেশ্য ছিল সে সময়ের ধনী বাঙালি সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার, বিলাসিতা, অশিক্ষা এবং কু-প্রথাকে ব্যঙ্গ ও তীব্র সমালোচনার মাধ্যমে তুলে ধরা এবং সমাজের সংস্কার করা।  

লেখক এই উপন্যাসে প্রথমবার চলিত বাংলাকে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করেন। এর আগে সাহিত্যকর্মগুলোতে সাধু ভাষা প্রচলিত ছিল। প্যারীচাঁদ মিত্র তাঁর লেখায় সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা, অর্থাৎ তদ্ভব শব্দ এবং দেশীয় বাগধারা ব্যবহার করেন, যা সাহিত্যকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে আসে। এটিই পরবর্তীকালে বাংলা গদ্যের চলিত রীতির ভিত্তি স্থাপন করে। 

আরও পড়ুনঃ আমাদের বিদ্যালয় সম্পর্কে ১০ টি বাক্য

‘আলালের ঘরের দুলাল’ কী? 

‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস বলে অনেক সাহিত্যিক মনে করেন। যদিও এই দাবিতে কিছু বিতর্ক আছে, তবে এটি বাংলা গদ্যরীতিতে এক নতুন অধ্যায় নির্মাণ করেছে। লেখক প্যারীচাঁদ মিত্র সাধারণ মানুষের কথ্যভাষা ও চলিত বাংলা গদ্যে প্রয়োগ করেছিলেন, যা তখনকার প্রচলিত সংস্কৃতিমুখ ভাষার বাইরে ছিল। সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের দুর্নীতি, শিক্ষাব্যবস্থা, নগর গ্রামের পার্থক্য এসব বিষয় তিনি উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। উপন্যাসটি শুধুই বিনোদনমূলক নয়, বরং তৎকালীন সমাজব্যবস্থা, শিক্ষা ও চরিত্রগঠনের বিষয়েও প্রশ্ন তোলে। 

‘আলালের ঘরের দুলাল’ কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ঃ 

আলালের ঘরের দুলাল হলো বাংলা সাহিত্যের এক ঐতিহাসিক সৃষ্টি, যা প্যারীচাঁদ মিত্র (ছদ্মনাম: টেকচাঁদ ঠাকুর) কর্তৃক রচিত। এটি প্রথম উপন্যাস আকারে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হওয়ার আগে ধারাবাহিকভাবে কিস্তি আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। উপন্যাসটি যে মাসিক পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়, তার নাম ছিল ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’। 

রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সম্পাদনায় প্রকাশিত এই পত্রিকাতেই ১৮৫৭ সালের এপ্রিল মাস থেকে ১৮৫৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত এটি প্রকাশিত হয়। এই প্রকাশনাটি কেবল একটি সাহিত্যকর্মের সূচনা ছিল না, বরং এটি ছিল বাংলা গদ্যে চলিত ভাষা (আলালী ভাষা) ব্যবহারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা পরবর্তী বাংলা উপন্যাস রচনার পথ প্রশস্ত করে।

‘আলালের ঘরের দুলাল’ কি বিষয়ক উপন্যাস? 

উপন্যাসটির মূল কাহিনি আবর্তিত হয়েছে ধনী জমিদার বাবুরাম বাবু ও তাঁর একমাত্র পুত্র মতিলালকে কেন্দ্র করে। বাবার অতি স্নেহ ও আদরে বড় হতে হতে মতিলাল হয়ে ওঠে এক উচ্ছৃঙ্খল, দায়িত্বহীন ও আনন্দপ্রিয় তরুণ। পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে সে সময় কাটায় খেলাধুলা, আড্ডা ও বিলাসে। লেখক অত্যন্ত বাস্তবধর্মী ভঙ্গিতে দেখিয়েছেন কীভাবে অতিরিক্ত আদর-যত্ন একজন সন্তানের চরিত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

উপন্যাসে মতিলালের জীবনের নানা উত্থান-পতন, স্কুল-কলেজের একঘেয়ে পরিবেশ, শহুরে জীবনের ভোগবিলাস এবং সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্যকে লেখক প্রাণবন্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। একই সঙ্গে তিনি শিক্ষার উদ্দেশ্য, আত্মনিয়ন্ত্রণ, সৎ চরিত্র গঠন এবং সামাজিক দায়িত্ববোধের গুরুত্বও তুলে ধরেছেন।

এছাড়া রচনাটিতে গ্রামীণ ও নগরজীবনের পার্থক্য, তৎকালীন শিক্ষা-ব্যবস্থা এবং ইংরেজ শাসনের সামাজিক প্রভাবও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। সব মিলিয়ে, ‘আলালের ঘরের দুলাল’ তৎকালীন সমাজের বাস্তব চিত্রকে হাস্যরসের আবরণে উপস্থাপন করে এক অনন্য জীবনদর্শন প্রকাশ করেছে।

‘আলালের ঘরের দুলাল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে পাঠকদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

‘আলালের ঘরের দুলাল’ যখন মাসিক পত্রিকা ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’- তে  ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করে, তখন এটি বাংলা সাহিত্যে এক মিশ্র অথচ ব্যাপক উৎসাহব্যঞ্জক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সাধারণ পাঠকমহলে উপন্যাসটি বিশাল জনপ্রিয়তা অর্জন করে, কারণ এতে তৎকালীন ধনী বাঙালি সমাজের অশিক্ষা, বিলাসিতা এবং কুসংস্কারের বাস্তব চিত্র ব্যঙ্গের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছিল, যা পাঠকদের কাছে সহজেই বোধগম্য ও আকর্ষণীয় ছিল। তবে এই উপন্যাসের সবচেয়ে বড় সমালোচিত এবং আলোচিত দিক ছিল এর ভাষাগত পরিবর্তন। 

প্যারীচাঁদ মিত্র তাঁর লেখায় সাধু ভাষার পরিবর্তে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা – তদ্ভব শব্দ ও দেশীয় বাগধারার মিশ্রণ ঘটিয়ে ‘আলালী ভাষা’ ব্যবহার করেন। প্রগতিশীল পাঠক ও সাহিত্যিকরা এই ভাষাকে স্বাগত জানালেও, রক্ষণশীল অংশটি এটিকে ‘বাজারি’ বা ‘গ্রাম্য’ আখ্যা দিয়ে তীব্র সমালোচনা করেন। এই বিতর্ক সত্ত্বেও, এই উপন্যাসের মাধ্যমে বাংলা গদ্য তার বাঁধাধরা নিয়ম থেকে মুক্তি পায় এবং এটিই পরবর্তী বাংলা উপন্যাস ও চলিত গদ্য রচনার শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করে।

উপন্যাসটির প্রকাশনা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কেন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়?

উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর প্রকাশনা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়, কারণ এটি বাংলা উপন্যাসের প্রথম দিকের বাস্তবধর্মী ও সমাজভিত্তিক রচনা হিসেবে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। এই উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যে আধুনিক উপন্যাসের কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে। 

লেখক প্যারীচাঁদ মিত্র এখানে প্রথমবারের মতো বাংলা গদ্যে একটি সম্পূর্ণ কাহিনি নির্মাণ করেন, যেখানে ঘটনা, চরিত্র, সংলাপ, এবং বাস্তব জীবনের প্রতিফলন স্পষ্টভাবে দেখা যায়। এই উপন্যাসের ভাষা ও শৈলী ছিল একেবারে নতুন লেখক চলিত ও রসাত্মক ভাষা ব্যবহার করে সাহিত্যকে সাধারণ পাঠকের কাছে সহজলভ্য করে তুলেছিলেন।

মতিলালের চরিত্র থেকে লেখক পাঠকদের কী শিক্ষণীয় বার্তা দিতে চেয়েছেন?

মতিলালের চরিত্রের মাধ্যমে লেখক প্যারীচাঁদ মিত্র পাঠকদের একটি গভীর শিক্ষণীয় বার্তা দিতে চেয়েছেন। অতিরিক্ত আদর ও বিলাসিতা মানুষকে জীবনের বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে দেয় এবং চরিত্রের অবক্ষয় ডেকে আনে। মতিলাল ধনী বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় শাসনের অভাবে অলস, ভোগবিলাসে আসক্ত ও দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে পড়ে। 

তার এই জীবনযাপন শেষ পর্যন্ত তাকে নৈতিক ও সামাজিকভাবে পতনের দিকে ঠেলে দেয়। লেখক এই চরিত্রের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন যে, সন্তানকে অতি আদরে নয়, বরং শাসন, শিক্ষা ও নীতির মাধ্যমে গড়ে তুলতে হয়; তাহলেই সে সমাজে সম্মানজনক ও সুশিক্ষিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।

শেষ কথা 

‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম আধুনিক উপন্যাস হিসেবে গণ্য করা হয়, কারণ এতে বাস্তব জীবন, সমাজ ও মানুষের মানসিকতার সজীব চিত্র ফুটে উঠেছে। প্যারীচাঁদ মিত্র রচিত এই উপন্যাসে প্রথমবারের মতো কল্পকাহিনির পরিবর্তে বাস্তব সমাজজীবনের প্রতিফলন দেখা যায়। এতে মতিলাল নামের এক যুবকের জীবন, তার বিলাসিতা, শিক্ষার প্রতি অনীহা ও সামাজিক পতনের কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। 

Author

  • শারমিন সিমি একজন প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষিকা, যিনি বর্তমানে ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা করছেন। তিনি অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন নিজ বিভাগে কৃতিত্বের সঙ্গে। শিক্ষাদানে তাঁর গভীর ভালোবাসা ও নিষ্ঠা তাঁকে শিক্ষার্থীদের প্রিয় করে তুলেছে।

    শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তিনি ওয়েবসাইটে নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ক তথ্য, পরামর্শ এবং অনুপ্রেরণামূলক লেখা প্রকাশ করেন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *