shaping public opinion

জনমত গঠনের সবচেয়ে শক্তিশালী বাহন কি এবং তা কীভাবে কাজ করে?

মানব সমাজে জনমত এক অনন্য শক্তি, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জনমত কখনো সরকারের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জোগায়, আবার কখনো প্রতিবাদ ও আন্দোলনের জন্ম দেয়। তবে জনমত হঠাৎ করে গড়ে ওঠে না; বরং নানা মাধ্যম বা বাহনের মাধ্যমে মানুষের চিন্তা, মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি ধীরে ধীরে প্রভাবিত হয়। আধুনিক যুগে এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী বাহন হলো গণমাধ্যম, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। 

জনমত স্বয়ংক্রিয়ভাবে গঠিত হয় না, বরং এটি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ধাপে ধাপে গড়ে ওঠে। তাই জনমত গঠনের প্রক্রিয়াকে গতিশীল ও সুসংগঠিত করার জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী বাহন। প্রশ্ন হলো, জনমত গঠনের সবচেয়ে শক্তিশালী বাহন কোনটি? সময়ের বিবর্তনে এই বাহনের রূপ পরিবর্তিত হয়েছে। একসময় পরিবার ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছিল প্রধান নিয়ন্ত্রক, কিন্তু আধুনিক যুগে গণমাধ্যম সেই স্থান দখল করেছে। যাইহোক এই সম্পর্কে আরও বিস্তারিত রয়েছে যেগুলো জানতে গেলে আপনাকে এই আর্টিকেল এর পরের অংশ অবশ্যই পড়তে হবে। 

আরও পড়ুনঃ চরমপন্থী নারীবাদ কি?

জনমত গঠন কেন গুরুত্বপূর্ণ? 

জনমত সমাজের সম্মিলিত চিন্তা ও অনুভূতির প্রতিফলন। যখন জনগণের বড় অংশ কোনো বিষয়ে একমত হয়, তখন সেটি সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সরাসরি প্রভাব ফেলে। গণতন্ত্রের ভিত্তি জনমতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। জনগণের মতামত ছাড়া গণতন্ত্র কার্যকর হতে পারে না। নির্বাচন, নীতিনির্ধারণ বা যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জনমতই মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। 

ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার আন্দোলন সবকিছুই শক্তিশালী জনমতের ফলাফল। যখন জনগণ একত্রিত হয়ে কোনো বিষয়ে সমমত হয়, তখন তা সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের পথ তৈরি করে। সরকার বা প্রতিষ্ঠান যদি ভুল পথে চলে, তখন জনগণের সম্মিলিত মতামত তাদেরকে সঠিক পথে ফেরাতে বাধ্য করে। 

এভাবে জনমত শাসন ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে। জনমতের গুরুত্ব এতটাই প্রবল যে, কোনো কর্তৃপক্ষ তা উপেক্ষা করলে জনরোষের মুখে পড়তে হয়। ফলে বলা যায়, জনমত সমাজ পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি।

জনমত গঠনের বাহন কী কী? 

জনমত গঠনের প্রধান বাহনগুলো হলো সেই সমস্ত মাধ্যম ও প্রতিষ্ঠান, যার মাধ্যমে সমাজে মানুষের সম্মিলিত ধারণা বা মতামত গড়ে ওঠে এবং ছড়িয়ে পড়ে। জনমত গঠনের জন্য যেসব মাধ্যম কাজ করে বা করে যাচ্ছে তা নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ 

  • পরিবার 

জনমত গঠনের ক্ষেত্রে পরিবার হলো সবচেয়ে প্রাথমিক ও মৌলিক বাহন। প্রতিটি ব্যক্তি প্রথম তার পরিবার থেকেই সামাজিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং রাজনৈতিক মনোভাবের প্রাথমিক ধারণা লাভ করে। শিশুর ব্যক্তিত্ব ও চিন্তাধারার ভিত্তি পরিবারেই গড়ে ওঠে, যা তাকে ভবিষ্যতের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলো সম্পর্কে মতামত তৈরি করতে সহায়তা করে। যদিও বৃহত্তর সামাজিক ইস্যুতে পরিবারের প্রভাব সরাসরি সীমিত, তবুও এটি ব্যক্তির মনের কাঠামো নির্ধারণ করে, যার ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে অন্য সব প্রভাব কাজ করে।

  • শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জন করে না, বরং বিতর্ক, আলোচনা এবং পাঠ্যক্রমের মাধ্যমে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যাগুলো বিশ্লেষণ করতে শেখে। একজন শিক্ষক বা শিক্ষাবিদের প্রভাব শিক্ষার্থীদের মননে দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং তারা তথ্যের ভিত্তিতে নিজস্ব মতামত গঠনে উৎসাহিত হয়। 

  • গণমাধ্যম

সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন এবং বর্তমানে ডিজিটাল মাধ্যমগুলি একই সময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছে দিতে সক্ষম। তাদের দ্রুততা এবং ব্যাপকতার কারণে যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা খুব দ্রুত জনমতকে প্রভাবিত করতে পারে। 

  • বন্ধুবান্ধব 

সমবয়সীদের সাথে মতবিনিময় এবং পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার প্রাপ্ত তথ্যের সত্যাসত্য যাচাই করে এবং নিজের মতকে সংশোধন বা শক্তিশালী করে। এই বাহনটি ব্যক্তির আচরণের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলে, কারণ একজন ব্যক্তি প্রায়শই সেই সমাজের রীতিনীতি ও মতবাদ মেনে চলতে চায়, যার সাথে সে সরাসরি যুক্ত।

  • রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান 

রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রচার, সমাবেশ এবং মতাদর্শের মাধ্যমে জনগণকে সংগঠিত করে এবং নির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্যে জনমতকে পরিচালিত করে। অন্যদিকে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজে নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং ঐক্যের ধারণা স্থাপন করে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বক্তব্য সমাজের একটি বড় অংশের মানুষের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস ও অভিন্ন মতামত তৈরি করতে পারে, যা বহু ক্ষেত্রে সরকারের নীতি বা সিদ্ধান্তকেও প্রভাবিত করে।

জনমত গঠনের সবচেয়ে শক্তিশালী বাহন কী?

ডিজিটাল যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জনমত গঠনের সবচেয়ে শক্তিশালী বাহনে পরিণত হয়েছে। ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব বা ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্ম মুহূর্তেই কোটি মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছে দেয়। একটি ভিডিও, ছবি বা পোস্ট কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয় এবং মানুষের চিন্তাভাবনায় প্রভাব ফেলে। এভাবে মানুষ একত্রিত হয়ে নির্দিষ্ট বিষয়ে মতামত জানায় এবং সংগঠিত আন্দোলনও শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বাংলাদেশের ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন, যেখানে সারাদেশের মানুষের জনমত গঠিত হয়েছিলো সমন্বয়কদের মাধ্যমে। 

তাঁদের একটি ফেসবুক পোস্ট মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে ১৭ কোটি মানুষের কাছে এবং তাঁরা আন্দোলনে আরও বেশি সোচ্চার হয়েছে। পরবর্তীতে দেশের মানুষই প্রতিটি খবর একজন আরেকজনের কাছে সেকেন্ডের মাধ্যমে পৌঁছে দিয়েছে। যার ফলস্বরূপ আজকের এই বিজয়। অনলাইন যা হলে এত দ্রুত এবং শক্তিশালী জনমত গঠন করা সম্ভব হত না কখনোই। 

জনমত গঠনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে পার্থক্য কী?

Media and social media

নিঃসন্দেহে জনমত গঠনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একভাবে কাজ করেনা। উভয়ের কাজ এবং কার্যকারিতার মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। চলুন পার্থক্য গুলো দেখে নেয়া যাকঃ 

গণমাধ্যম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
এটি একটি একমুখী যোগাযোগ এটি দ্বিমুখী যোগাযোগ
সম্পাদক ও সাংবাদিকদের মাধ্যমে যাচাইকৃত তথ্য যেকোনো ব্যবহারকারী প্রকাশ করতে পারে, ভুয়া খবর ছড়ানোর ঝুঁকি বেশি
নির্দিষ্ট সময়ে প্রচারিত এবং ধীর কার্যক্রম তাৎক্ষণিক, মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে
দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব, বিশ্বাসযোগ্যতা বেশি দ্রুত জনমত তৈরি করে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে প্রভাবশালী
সাধারণ মানুষের সরাসরি অংশগ্রহণ সীমিত সবাই সরাসরি অংশ নিতে পারে

FAQs

অতীতে জনমত গঠনের জন্য কোন কোন বাহন ব্যবহার করা হতো?

সংবাদপত্র ছিল জনমত গঠনের অন্যতম প্রধান বাহন। বিভিন্ন সম্পাদকীয়, প্রতিবেদন ও প্রবন্ধ মানুষের চিন্তাধারায় প্রভাব ফেলেছে। সাহিত্য ও সংস্কৃতি মানুষের মধ্যে স্বাধীনচেতা মনোভাব জাগিয়ে তুলেছে। কবিতা, গান, নাটক এবং গল্পের মাধ্যমে সমাজে অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছে।

আধুনিক যুগে গণমাধ্যম কীভাবে জনমত গঠনে প্রভাব ফেলে?

গণমাধ্যমের মাধ্যমে মানুষ দেশ-বিদেশের খবর জানতে পারে, আর সেই তথ্য তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাভাবনায় সরাসরি প্রভাব ফেলে। একটি সংবাদ প্রচারের পর মানুষ তা নিয়ে আলোচনা করে এবং নিজেদের মতামত তৈরি করে। এছাড়া, নির্বাচনের আগে প্রচারণা, রাজনৈতিক বিতর্ক বা নেতাদের সাক্ষাৎকার প্রচারের মাধ্যমে ভোটারদের মত পরিবর্তন হতে পারে। 

জনমত গঠনের সবচেয়ে শক্তিশালী বাহন ব্যবহারের ক্ষেত্রে কী ধরনের সতর্কতা নেওয়া উচিত?

প্রথমেই যে কোনো তথ্য প্রচারের আগে তার সত্যতা যাচাই করতে হবে, কারণ ভুয়া খবর বা বিভ্রান্তিকর তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে জনমতকে ভুল পথে পরিচালিত করতে পারে। নৈতিকতা বজায় রাখা এবং আইন ও নীতিমালা অনুসরণ করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অবাধ বা দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রচার সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে। তদুপরি, ব্যক্তির গোপনীয়তা রক্ষা করা উচিত এবং কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সম্মানহানি ঘটায় এমন কনটেন্ট প্রচার করা যাবে না। 

Author

  • শারমিন সিমি একজন প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষিকা, যিনি বর্তমানে ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা করছেন। তিনি অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন নিজ বিভাগে কৃতিত্বের সঙ্গে। শিক্ষাদানে তাঁর গভীর ভালোবাসা ও নিষ্ঠা তাঁকে শিক্ষার্থীদের প্রিয় করে তুলেছে।

    শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তিনি ওয়েবসাইটে নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ক তথ্য, পরামর্শ এবং অনুপ্রেরণামূলক লেখা প্রকাশ করেন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *