উদারপন্থী নারীবাদ কি? উদ্দেশ্য ও বৈশিষ্ট্য কী কী?
উদারপন্থী নারীবাদ বা Liberal Feminism হলো নারীবাদের একটি ধারা, যেখানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করার উপর জোর দেওয়া হয়। এ ধারার মূল লক্ষ্য হলো সমাজে বিদ্যমান আইন, নীতি ও সামাজিক ব্যবস্থার ভেতরে থেকেই নারীর অবস্থান উন্নত করা। এটি বিশ্বাস করে যে সমাজের ভেতরে বিদ্যমান আইন, শিক্ষা ও নীতিমালা সংস্কারের মাধ্যমে নারীরা পুরুষদের সমান মর্যাদা ও অবস্থান পেতে পারে।
আমরা উদারপন্থী নারীবাদ কি সেটা জানলাম কিন্তু আমাদের জানা এখনও শেষ হয়নি। উদারপন্থী নারীবাদ সম্পর্কে আজ আমরা আপনাকে এমন কিছু তথ্য দিলে চলেছি যেগুলো হয়তো এই মুহূর্ত পর্যন্ত আপনার অজানা। আশা করছি পুরো লেখাটি পড়লে আপনাদের ধারণা একেবারে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
আরও পড়ুনঃ তথ্য অধিকার আইন কি?
উদারপন্থী নারীবাদ কি?
উদারতাবাদ নামক রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি থেকেই উদারপন্থী নারীবাদ তত্ত্বের সূত্রপাত ঘটে। এই ধারার প্রতিনিধিত্ব করেছেন মেরী ওলস্টোনক্রাফট, জন স্টুয়ার্ট মিল, হ্যারিয়েট টেইলর, বেটি ফ্রাইডানসহ আরও অনেক চিন্তাবিদ। এদের মধ্যে জন স্টুয়ার্ট মিলকে প্রথম প্রবক্তা হিসেবে ধরা হয়। ব্রিটিশ এই উপযোগবাদী দার্শনিক ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত তার বিখ্যাত গ্রন্থ “The Subjection of Women”-এ নারীর অধিকার, সমতা ও স্বাধীনতা নিয়ে সুস্পষ্টভাবে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও তত্ত্ব উপস্থাপন করেন।
আধুনিক উদারপন্থী নারীবাদী চিন্তাবিদদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ নাম হলো মেরি ওলস্টোনক্রাফট, বেটি ফ্রাইডান এবং নওমি উলফ। নওমি উলফ নারীদের জন্য সমান অধিকার ও সুযোগের দাবি তুলেছিলেন, তবে সমাজে মৌলিক পরিবর্তনের পক্ষে ছিলেন না। এই কারণে তিনি অনেকের কাছে সমালোচিত হন। অন্যদিকে বেটি ফ্রাইডান শ্রমের বিভাজনকেই নারীর অধীনস্থ অবস্থার মূল কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।
তার মতে, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত নারীরা সংসার ও স্বামীর দায়িত্বে আবদ্ধ থেকে নিজেদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারেন না। তিনি নারীর দুরবস্থার জন্য মাতৃত্বের দায়িত্বকেও আংশিকভাবে দায়ী করেছেন। ফ্রাইডান বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমেই নারীরা নিজেদের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠে পুরুষদের সমান মর্যাদা অর্জন করতে পারবে।
উদারপন্থি নারীবাদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ
উদারপন্থি নারীবাদের মূল লক্ষ্য হল সমাজের প্রচলিত কাঠামো বা নিয়ম-নীতি পরিবর্তন না করে নারীর পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা। উদারপন্থি নারীবাদের তাত্ত্বিকদের মধ্যে কিছু ভিন্নমত থাকলেও, অধিকাংশের দৃষ্টিকোণ থেকে এই আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্যগুলো নিম্নরূপ:
সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা
নারী সমাজে সমান মর্যাদা ও স্বীকৃতি পাবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক অনুষ্ঠান বা যেকোনো সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য থাকবে না। নারীর মতামত ও অংশগ্রহণকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হবে।
সম্পত্তি সংক্রান্ত অধিকার
নারীর সম্পত্তি ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের অধিকার নিশ্চিত করা। এটি নারীকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে সাহায্য করবে এবং পরিবার বা সমাজে নারীর অবস্থানকে শক্তিশালী করবে।
পারিবারিক অধিকার প্রতিষ্ঠা
নারী তার পরিবারে সমানভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার রাখবে। সন্তান লালন-পালন, পরিবার পরিকল্পনা, বৈবাহিক সম্পর্ক এবং পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয়ে নারী-পুরুষ সমান অধিকার থাকবে।
অর্থনৈতিক অধিকার
নারীকে চাকরি, ব্যবসা বা অর্থ উপার্জনের সমান সুযোগ দেওয়া হবে। আর্থিক স্বাধীনতার মাধ্যমে নারীর উপর নির্ভরতা কমবে এবং সমাজে নারী-পুরুষ বৈষম্য ধীরে ধীরে কমে যাবে।
রাজনৈতিক অধিকার
নারী ভোট দেওয়া, নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং সরকারি পদে নিযুক্ত হওয়ার অধিকার পাবে। এর মাধ্যমে নারী সমাজে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় এবং সমানভাবে অংশগ্রহণকারী হবে।
আইনগত অধিকার
নারী আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে সমান সুরক্ষা এবং সুযোগ পাবে। শোষণ, অত্যাচার বা বৈষম্যের ক্ষেত্রে আইন নারীর পক্ষ নেবে এবং তাকে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা দেবে।
উদারপন্থি নারীবাদের বৈশিষ্ট্য গুলো কী কী?

উদারপন্থি নারীবাদের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। এই বৈশিষ্ট্য গুলো আপনাদের কাছে এই মতবাদের গুরুত্বকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরবেঃ
- নারী ও পুরুষকে সমান শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা। এটি নারীকে জ্ঞান, দক্ষতা এবং আত্মনির্ভরশীল করে তোলে।
- নারীর ভোটাধিকার নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা।
- নারী ও পুরুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা এবং নারীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করা।
- নারীর মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা। এটি নারীর ব্যক্তিত্ব ও সমাজে অংশগ্রহণকে শক্তিশালী করে।
- নারীর সরকারী ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করা, যাতে নারী সমাজে সমানভাবে নেতৃত্ব দিতে পারে।
- নারীর প্রতি সকল রকম শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সহিংসতা দূর করা।
- নারীর নিজস্ব সত্তা ও স্বাতন্ত্র্য বিকাশের সুযোগ নিশ্চিত করা, যাতে নারী তার আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
FAQs
উদারপন্থী নারীবাদ পুরুষদের সঙ্গে নারীর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে কেন গুরুত্ব দেয়?
মানুষ জন্মগতভাবে যুক্তিবাদী এবং নিজের জীবন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। উদারপন্থী নারীবাদীরা যুক্তি দেন যে, পুরুষদের মতোই নারীরাও যৌক্তিক ব্যক্তি। তাই, যদি পুরুষের আইনি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার থাকে, তবে যুক্তির দিক থেকে নারীরও একই অধিকার থাকা উচিত। পুরুষদের অধিকারের মানদণ্ডকে ভিত্তি করেই নারীদের জন্য সমান অধিকার দাবি করা হয়।
উদারপন্থী নারীবাদ সমাজে আইনি সংস্কারের মাধ্যমে নারী-পুরুষ সমতার জন্য কিভাবে কাজ করে?
উদারপন্থী নারীবাদীরা বিশ্বাস করে যে বৈষম্যের মূল কারণ হলো বৈষম্যমূলক আইন। তাই তারা এমন আইন প্রণয়নের জন্য লড়াই করে যা নারীদের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করে। যেমন, ভোটাধিকার, কর্মক্ষেত্রে সমান বেতন, সম্পত্তির অধিকার এবং বিবাহ-বিচ্ছেদ ও সন্তানের অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে সমান অধিকার নিশ্চিত করা।
শেষ কথা
উদারপন্থি নারীবাদ একটি প্রাতিষ্ঠানিক আন্দোলন, যার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যন্ত বড়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে নারীরা ধীরে ধীরে লিঙ্গভিত্তিক, আইনগত এবং রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা অর্জন করছে। এর ফলে তারা নিজের জীবন, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে। একই সঙ্গে, এই আন্দোলন নারী ও পুরুষের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা শক্তিশালী করছে। যদি এই আন্দোলন আরও জোরদার করা হয়, তাহলে নারীর অধিকার সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
