পৃথিবীর সবচেয়ে গরম দেশ কোনটি? কেন এত গরম পড়ে?
প্রকৃতি আমাদের কাছে কখনো শান্ত, কখনো আবার প্রচণ্ড তীব্র রূপে ধরা দেয়। কোথাও বরফে ঢেকে থাকা হিমশীতল দেশ, আবার কোথাও প্রচণ্ড তাপদাহে জ্বলছে ভূমি। এই বৈচিত্র্যময় আবহাওয়ার মধ্যে অনেকের মনে একটি প্রশ্ন জাগে পৃথিবীর সবচেয়ে গরম দেশ কোনটি? এই প্রশ্নের উত্তর শুধু কৌতূহলের জন্য নয়, বরং জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ, মানবজীবন ও প্রযুক্তিগত অভিযোজন সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াকে গভীর করে তোলে।
পৃথিবীর প্রতিটি দেশ ও অঞ্চলের আবহাওয়া ভিন্ন। কেউ সারা বছর ঠান্ডায় কাঁপে, কেউ আবার গরমে পুড়ে যায়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, উত্তর আফ্রিকার কিছু অঞ্চল এবং দক্ষিণ এশিয়ার কিছু অংশে বছরের বেশিরভাগ সময় প্রচণ্ড গরম থাকে। আজ আমরা জানবো কোন দেশটি পৃথিবীর সবচেয়ে গরম, কেন সেখানে এত বেশি গরম পড়ে।
আরও পড়ুনঃ কোন ধাতু পানিতে ফেললে আগুন ধরে যায়?
পৃথিবীর সবচেয়ে গরম দেশ কোনটি?
বিভিন্ন রেকর্ড ও জলবায়ু পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, পৃথিবীর সবচেয়ে গরম দেশ হলো কুয়েত। ২০১৬ সালে কুয়েতের মিত্রিবাহ নামক স্থানে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৫৪°C (১২৯.২°F)। এটি আধুনিক কালে পৃথিবীর অন্যতম সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। কুয়েত একটি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ, যার অবস্থান আরব উপদ্বীপে। এখানে গ্রীষ্মকাল অত্যন্ত দীর্ঘ ও শুষ্ক, এবং প্রায় মে মাস থেকে অক্টোবর পর্যন্ত তাপমাত্রা ৪৫–৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। দিনের বেলায় সূর্যের তেজ এতটাই প্রবল থাকে যে বাইরে বের হওয়া কঠিন হয়ে যায়। এ কারণে অধিকাংশ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা গ্রীষ্মে সম্পূর্ণভাবে বদলে যায়।
কুয়েতের পরিবেশ কর্তৃপক্ষের অনুমান অনুযায়ী, ২০৭১ থেকে ২১০০ সালের মধ্যে দেশের কোনো অঞ্চলে গড় তাপমাত্রা প্রায় ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে দেশটির অনেক অঞ্চলে মানুষের বসবাস কঠিন বা অসম্ভব হয়ে উঠবে।
এত তাপদাহের মধ্যে বন্য প্রাণীরাও ক্রমশ কষ্টে পড়ছে। জীবনধারণের প্রাকৃতিক পরিবেশ এখন তাদের জন্য নিরাপদ নয়। গরমের তীব্রতা ও পানির অভাবে ঘরের ছাদে মৃত পাখি পাওয়া যায়। শহরের মালিকহীন বিড়ালগুলোও মূমুর্ষ অবস্থায় উদ্ধার করে পশু চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হচ্ছে। মরুদ্যান ও মরুগুল্ম শুকিয়ে যাচ্ছে, এবং সামান্য বৃষ্টির পানি খুব দ্রুত শুকিয়ে যাওয়ায় মরুপ্রাণীরা কুয়েত সিটির আশেপাশের সবুজ অঞ্চলে ভিড় করছে। কিন্তু সেখানে তাদের উপস্থিতি নিয়ে মানুষ প্রায়ই ক্ষেপে উঠছে, ফলে প্রাণীদের জন্য বিপদ আরও বাড়ছে।
কুয়েতে এত গরম পড়ে কেন?

কুয়েতে কেমন গরম পড়ে তা সেখানে যারা থাকে তাঁরা খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু কেন সেখানে এত গরম? আসুন কারণ গুলো পর্যায়ক্রমে জেনে নেওয়া যাকঃ
-
ভৌগোলিক অবস্থান
কুয়েত আরব উপদ্বীপের মধ্যভাগে অবস্থিত, যা পৃথিবীর বিষুবরেখা ও মরুভূমি অঞ্চলের নিকটে। এই অবস্থান সূর্যের তাপকে সরাসরি এবং তীব্রভাবে প্রভাবিত করে। ফলে বছরের অধিকাংশ সময়ে সূর্যের তাপ প্রবল থাকে এবং তাপমাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
-
মরুভূমি পরিবেশ
কুয়েতের অধিকাংশ এলাকা মরুভূমি, যেখানে গাছপালা কম এবং মাটি শুকনো। এ ধরনের ভূমি দ্রুত উত্তপ্ত হয় এবং দিনের বেলা তাপমাত্রা খুব দ্রুত বাড়ে। মরুভূমিতে সূর্যের তাপ শোষিত হয় এবং রাতের সময় ধীরে ধীরে ছেড়ে দেয়, যা দিনের তাপকে আরও তীব্র অনুভূত করায়।
-
আর্দ্রতার কমতি
মরুভূমি ও কম বৃষ্টিপাতের কারণে কুয়েতে বাতাসে আর্দ্রতার মাত্রা খুব কম থাকে। আর্দ্রতা কম থাকলে পানি বাষ্পীভূত হয়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ফলে তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধি পায় এবং মানুষ ও পরিবেশের জন্য গরম আরও কষ্টদায়ক হয়।
-
স্থলভাগের প্রাধান্য
যদিও কুয়েত উপকূলীয় দেশ, তবে শহরের ও অধিকাংশ অঞ্চলের ভূমি মূলত স্থলভাগ। স্থলভাগে সূর্যের তাপ দ্রুত শোষিত হয় এবং সমুদ্রের তুলনায় তাপমাত্রা বেশি থাকে। সমুদ্রের কাছাকাছি এলাকা তুলনামূলকভাবে ঠান্ডা থাকলেও স্থলভাগের অঞ্চলগুলোতে গরম প্রবল হয়।
-
জলবায়ু পরিবর্তন
গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে মরুভূমি অঞ্চলে তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। অতীতের তুলনায় কুয়েতে গ্রীষ্মকাল আরও দীর্ঘ এবং তীব্র হয়েছে। এটি কেবল মানুষের জীবনযাত্রা নয়, কৃষি, পানি সংস্থান এবং জীববৈচিত্র্যকেও প্রভাবিত করছে।
-
দীর্ঘ গ্রীষ্মকাল
কুয়েতের গ্রীষ্ম সাধারণত মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। এই সময়ে প্রচণ্ড শুষ্ক এবং দীর্ঘ দিন পর্যন্ত সূর্যের তাপ প্রবল থাকে। দীর্ঘ গ্রীষ্মকাল এবং শুকনো আবহাওয়া একত্রিত হয়ে তাপমাত্রাকে অত্যন্ত কষ্টকর করে তোলে।
কুয়েতে অতিরিক্ত গরম পড়ার ফলে কী কী সমস্যা হয়?
বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক মধ্যপ্রাচ্যে কাজের সুযোগের খোঁজে যান। তাদের মধ্যে অধিকাংশই স্বল্পদক্ষতা সম্পন্ন এবং মূলত নির্মাণ, পরিচ্ছন্নতা ও অন্যান্য কায়িক শ্রমের কাজ করেন। শীতাতপহীন, উন্মুক্ত পরিবেশে কাজ করার কারণে গ্রীষ্মকালে তাদের শারীরিক সমস্যা তৈরি হয়, এবং এই সমস্যার মাত্রা আগামীতে বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রচণ্ড তাপদাহের কারণে হিটস্ট্রোক, ডিহাইড্রেশন এবং ক্লান্তি বৃদ্ধি পায়। দীর্ঘ সময় খোলা ও গরম পরিবেশে কাজ করলে কার্ডিওভাসকুলার সমস্যা ও রক্তচাপের সমস্যা হতে পারে। এছাড়া বন্য প্রাণী তীব্র গরমে জীবনধারণে সমস্যায় পড়ে। পানির অভাবে মরুভূমির প্রাণীরা শহরের আশেপাশের সবুজ অঞ্চলে ভিড় করছে, কিন্তু সেখানে তাদের নিরাপত্তা নেই।
শারীরিক শ্রমে নিযুক্ত প্রবাসী শ্রমিকরা গরমে কাজ করতে গিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন। নির্মাণ, পরিচ্ছন্নতা এবং অন্যান্য কায়িক কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের জন্য দীর্ঘ সময় বাইরে থাকা বিপজ্জনক। গরমের কারণে কর্মক্ষমতা কমে এবং শারীরিক অসুস্থতা বাড়ে।
FAQs
কুয়েতের গরম আবহাওয়ায় শ্রমিকদের জন্য কোন ধরনের সতর্কতা প্রয়োজন?
পর্যাপ্ত পানি পান করা অত্যন্ত জরুরি, কারণ প্রচণ্ড তাপে দেহ সহজে ডিহাইড্রেশন বা পানি স্বল্পতার শিকার হতে পারে। হালকা ও শীতল পোশাক পরা এবং সরাসরি সূর্যের আলো এড়ানো গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে দুপুরের তাপপ্রবাহের সময়। এছাড়া পর্যাপ্ত বিরতি নেওয়া এবং কাজের সময় ভাগ করা উচিত, যাতে শরীর অতিরিক্ত গরমে ক্লান্ত না হয়।
কুয়েতের মরুভূমি পরিবেশে তাপমাত্রা কেন এত দ্রুত বৃদ্ধি পায়?
মরুভূমির বালি বা মাটি জলীয় বাষ্প ধরে রাখতে পারে না, ফলে দিনের বেলায় সূর্যের তীব্র বিকিরণ সরাসরি ভূপৃষ্ঠকে আঘাত করলে তা দ্রুত তাপ শোষণ করে এবং পরিবেশের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক গতিতে বাড়িয়ে তোলে। অন্যদিকে, বায়ুমণ্ডলে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কম থাকায় তাপ ধরে রাখার প্রাকৃতিক ক্ষমতা কমে যায়, যার ফলে তাপমাত্রা দ্রুততম সময়ে সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যায়।
কুয়েতে গ্রীষ্মকালে পানি এবং ছায়ার অভাবের কারণে কোন ধরনের প্রাণী সমস্যায় পড়ছে?
কুয়েতে গ্রীষ্মকালে পানি ও ছায়ার অভাবের কারণে বিভিন্ন বন্য প্রাণী তীব্র সমস্যায় পড়ছে। মরুভূমির প্রাণীরা প্রাকৃতিক ছায়া এবং পানির উৎস না পাওয়ায় ডিহাইড্রেশন, তাপদাহ ও ক্লান্তির শিকার হচ্ছে। এর ফলে অনেক পাখি বাড়ির ছাদে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। শুকিয়ে যাওয়া মরুদ্যান ও মরুগুল্মের কারণে প্রাণীরা খাবার ও পানি খুঁজতে শহরের আশেপাশের সবুজ অঞ্চলে ভিড় করছে। কিন্তু সেখানে মানুষের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কারণে তাদের নিরাপত্তা আরও হুমকির মুখে পড়ছে।
