sharia law

শরিয়া আইন কি? ইসলামি শরিয়া আইনের বিস্তারিত

শরিয়া আইন হলো আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে প্রদত্ত বিধানসমূহের সমষ্টি। এটি কোনো মানুষের তৈরি আইন নয়, তাই একে Divine Law বলা হয়। তবে সময় ও পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আলেমরা নিজেদের জ্ঞান, যুক্তি এবং ইজতিহাদের মাধ্যমে এই আইনের বিভিন্ন দিককে ব্যাখ্যা ও সম্প্রসারণ করেছেন। ইসলামী শরিয়াহ আইনে মানুষের ব্যাখ্যা ও প্রয়োগের সুযোগ থাকলেও তা কখনোই কোরআন ও সুন্নাহর মূলনীতিকে অতিক্রম করতে পারে না। 

শরিয়া মূলত অপরিবর্তনীয়, কারণ কুরআন ও সুন্নাহ সর্বদাই চিরন্তন ও অবিকৃত থাকবে। তবে ইজতিহাদের ক্ষেত্রে আলেমদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিতে পারে, আবার সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী ইজতিহাদে ভিন্নতাও আসতে পারে। তবুও এসব ভিন্নতা সবসময় শরিয়াহর নির্ধারিত সীমারেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে এবং কখনো মূলনীতি থেকে বিচ্যুত হবে না। আজ আমরা বিস্তারিত ভাবে জানবো যে শরিয়া আইন কি এবং সাধারণ আইনের সাথে এর পার্থক্য সম্পর্কে। 

আরও পড়ুনঃ তথ্য অধিকার আইন কি?

শরিয়া আইন কি?

কুরআনের বাণীতে আল্লাহ মানুষকে যে আদর্শ জীবনবিধি শিখিয়েছেন, সেটিই শরিয়াহ বা ইসলামী আইন নামে পরিচিত। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, আল্লাহ, তাঁর রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং কোরআনের প্রতি দৃঢ় আস্থা রাখার মাধ্যমেই একজন মানুষ মুসলমান হিসেবে স্বীকৃত হয়। একজন ব্যক্তি যখন শরিয়াহর বিধিনিষেধ মেনে চলে এবং নিজের জীবন ও আচার-আচরণ সেই অনুযায়ী পরিচালিত করে, তখনই সে প্রকৃত অর্থে মুসলমান হয়। 

যদিও শরিয়াহর সব বিধান সবসময় সবার পক্ষে পালন করা সম্ভব হয় না, তবুও কোরআনের প্রতি ঈমান ও বিশ্বাস একজন মুসলমানের ধর্মীয় পরিচয়কে অটুট রাখে। শরিয়াহ এমন এক জীবনব্যবস্থা, যা মুসলমানদের মাঝে আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করে তোলে, তারা পৃথিবীর যেকোনো স্থানে থাকুক না কেন। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে, শরিয়া মেনে চলার মাধ্যমে মানুষ এ দুনিয়ায় ন্যায় ও প্রশান্তি এবং পরকালে মুক্তি ও শান্তি লাভ করে।

‘শরিয়া’ বা ‘শর’ শব্দের আদি অর্থ হলো জলের দিকে নিয়ে যাওয়া পথ, অর্থাৎ জীবনের উৎসের পথ। আরবি ক্রিয়াপদ ‘শরা’-এর অর্থও হলো জলের দিকে পরিচালিত করা, যা মূলত জীবন রক্ষাকারী পথ নির্দেশ করে। এই প্রেক্ষাপটে শরিয়া বলতে বোঝানো হয় এমন একটি প্রশস্ত ও সঠিক জীবনপথ, যা ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতে গঠিত এবং মানুষের জন্য কল্যাণকর জীবনযাপনের নির্দেশনা প্রদান করে। শরিয়া আসলে আল্লাহর নির্ধারিত পথ, যা অনুসরণ করলে মানুষ একটি সুন্দর, সার্থক ও পরিপূর্ণ জীবন লাভ করতে পারে।

শরিয়া আইনের উদ্দেশ্য কী?

Purpose of Sharia Law

ইসলামে যে ‘আল-ছিরাত-উল-মুস্তাক্বিম’ বা ‘সহজ সরল পথ’ কথাটি ব্যবহার করা হয়, তা শরিয়াহর মধ্যে ‘আল-হিদায়া’। হিদায়া মানে হলো আল্লাহ আমাদের সেই পথ দেখিয়েছেন, যা অনুসরণ করলে আমরা সঠিক ও কল্যাণকর জীবনের দিকে এগোতে পারি। এই পথপ্রদর্শন দুইভাবে আসে – একটি হলো আল্লাহর নিজস্ব নির্দেশনা, যা মানুষকে সত্যের পথে চালিত করে, এবং অন্যটি হলো মহানবী মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক প্রদত্ত দিকনির্দেশনা, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবন ও আচরণের সঠিক রূপরেখা দেখায়। এই নির্দেশনা ও পথ মুসলিম জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা আমাদের ধর্ম এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাহায্য করে।

শরিয়াহর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে এমনভাবে পরিচালনা করা, যাতে সে পরকালে শান্তি ও মুক্তি লাভ করতে পারে। একই সঙ্গে এটি একটি সুস্থ, সুন্দর, ন্যায়সংগত ও সুষম সমাজ গঠনে সহায়ক। শরিয়াহ কেবল নির্দিষ্ট কিছু কর্ম বা আচরণের নিয়ন্ত্রণ নয়; বরং মানুষের প্রতিটি কাজকর্ম ও জীবনপর্যায়ের সঙ্গে এটি জড়িত এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ সম্ভব।

শরিয়াহর দৃষ্টিতে মুসলিম বা ইসলামী আইনকে একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় আইন হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, সকল মুসলমানের দায়িত্ব হলো আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য বজায় রাখা, নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং ফেরেশতাগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা এবং মুসলিম আইনের গ্রন্থাবলির বিধি ও নিয়মকানুন যথাযথভাবে পালন করা। এই নির্দেশনা অনুসরণ করলেই একজন মুসলিম ইহকালে ও পরকালে সত্যিকার মুক্তি ও কল্যাণ লাভ করতে পারে।

FAQs

যারা মুসলিম হয়েও শরিয়া বাস্তবায়ন করেনা তাঁদের জন্য কী হুকুম রয়েছে? 

কেউ যদি নিজেকে মুসলমান দাবি করে, কিন্তু শরিয়াহর বাস্তবায়নের কথা উঠলে ভয় পায় বা এর বিরোধিতা করে, তবে এটি ইসলামের মূল শিক্ষার বিপরীত মনোভাব প্রকাশ করে। শরিয়াহ প্রতিষ্ঠা মুসলমানের জন্য কল্যাণ ও ন্যায়ের পথ; এতে অনীহা বা বিরক্তি দেখানো ঈমানের দুর্বলতার পরিচায়ক।

ইসলামী শরিয়াহ কেবল ব্যক্তিগত ইবাদত ও আমলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যও এটি একটি পূর্ণাঙ্গ আইনব্যবস্থা। যে ব্যক্তি মুসলিম পরিচয় বহন করেও শরিয়াহর পরিবর্তে আধুনিক আইনকে অগ্রাধিকার দেয় বা শরিয়াহ প্রয়োগের বিরোধিতা করে, তার অবস্থান ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। ইসলাম এ ধরনের মানসিকতাকে সমর্থন করে না; বরং একে ঈমানের ঘাটতি হিসেবে গণ্য করা হয়।

ইসলামে শরিয়া আইন কোন কোন ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য?

ইসলামে শরিয়া আইন জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য। এটি শুধু আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় দিকের জন্য সীমাবদ্ধ নয়, বরং ব্যক্তিগত, সামাজিক, পারিবারিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনকেও নিয়ন্ত্রণ করে। ইবাদতের ক্ষেত্রে এটি নামাজ, রোজা, জাকাত, হজ্জের মতো দায়িত্ব পালন নিশ্চিত করে। ব্যক্তিগত জীবনে এটি নৈতিকতা, সততা, ও পারস্পরিক সম্মানের মতো আচরণ বজায় রাখতে সহায়ক। পরিবার ও বিবাহবিবাদের ক্ষেত্রে এটি বিয়ে, তালাক, সন্তান ও উত্তরাধিকার সম্পর্কিত বিধান প্রদানের মাধ্যমে সুশৃঙ্খল পরিবার গঠনে ভূমিকা রাখে। এছাড়াও আরও অনেক ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ রয়েছে। 

অর্থনীতি ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে শরিয়া আইন মেনে চলা প্রয়োজন কেন? 

অর্থনীতি ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে শরিয়া আইন মেনে চলার মাধ্যমে ন্যায়সঙ্গত লেনদেন ও আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। ফৌজদারি ও সামাজিক ক্ষেত্রে এটি অন্যায় থেকে রক্ষা করে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। ফলে শরিয়া আইন মেনে চলা কেবল ধর্মীয় দায়িত্ব নয়, বরং একজন মুসলিমের জীবনে শান্তি, ন্যায় ও কল্যাণের নিশ্চিত পথ।

শরিয়া আইন এবং সাধারণ আইন একে অপরের সাথে কীভাবে ভিন্ন?

শরিয়া আইনের লক্ষ্য হলো মানুষের পরকালের কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং নৈতিক ও সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখা, যেখানে সাধারণ আইনের লক্ষ্য মূলত সামাজিক শৃঙ্খলা, ন্যায়বিচার ও রাষ্ট্র পরিচালনা। এছাড়াও, শরিয়া আইন ঈশ্বর প্রদত্ত নীতি অনুযায়ী পরিচালিত হওয়ায় তা সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য, কিন্তু সাধারণ আইন সর্বত্র সমানভাবে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে।

শেষ কথা

শরিয়াহ আইন ও প্রচলিত সাধারণ আইন কেবল ভিন্ন ধরনের নয়; বরং তাদের ভিত্তি ও নীতিগত দিক থেকে রয়েছে ব্যাপক পার্থক্য। শরিয়াহ এসেছে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর পক্ষ থেকে, আর সাধারণ আইন মানুষের অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজন অনুযায়ী প্রণীত। ফলে শরিয়াহ অপরিবর্তনীয় ও চিরন্তন, কিন্তু সাধারণ আইন সময় ও সমাজের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয় এবং সবক্ষেত্রে নিঃশর্তভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। 

এ কারণে শরিয়ার সঙ্গে ফিক্বহকে এক করা যায় না, কারণ ফিক্বহ মূলত মানবীয় ইজতিহাদের ফল এবং প্রয়োজনে তা সংশোধনযোগ্য। অন্যদিকে, শরী‘আহ কোনো সংস্কার বা সংশোধনের অধীন নয়। তাই যে কোনো আইনগত আলোচনা বা ফিক্বহ বিষয়ক পর্যালোচনায় শরী‘আহকে মূল মানদণ্ড হিসেবে সামনে রাখা অপরিহার্য, যাতে তা সাধারণ আইনের সমপর্যায়ে সীমাবদ্ধ না হয় এবং আল্লাহর আইনের শ্রেষ্ঠত্ব অক্ষুণ্ণ থাকে।

Author

  • শারমিন সিমি একজন প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষিকা, যিনি বর্তমানে ঢাকা কলেজে শিক্ষকতা করছেন। তিনি অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন নিজ বিভাগে কৃতিত্বের সঙ্গে। শিক্ষাদানে তাঁর গভীর ভালোবাসা ও নিষ্ঠা তাঁকে শিক্ষার্থীদের প্রিয় করে তুলেছে।

    শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তিনি ওয়েবসাইটে নিয়মিত শিক্ষাবিষয়ক তথ্য, পরামর্শ এবং অনুপ্রেরণামূলক লেখা প্রকাশ করেন।

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *